ব্ল্যাকহোল ইনিশিয়েটর রহস্য

বিভাবসু দে



সারা ঘর জুড়ে অতিকায় সব মেশিনের ছড়াছড়ি, লাল নীল আলো জ্বলে জ্বলে উঠছে তাতে। সিলিকোনিয়ামের তৈরী এক্সপেরিমেন্টাল স্যুট পরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মধ্যে, সবার চোখেই একটা দারুণ উৎকণ্ঠার ছাপ। মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে উঠছে কিছু ডিজিটাল ছবি, আবার কিছু বাইনারি ডাটাও। হঠাৎ ম্যাটার ট্রান্সপোর্টেশন চেম্বারের হলুদ আলোটা জ্বলে উঠল, একটু পরেই তাতে দেখা গেল প্রফেসর হিউনেসকে, সাথে আরেকজন কে যেন। দুজনেই চেম্বার থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন ঘরের মধ্যিখানে, সাদা টেবিলের ওপর আধভাঙা সুপারগ্লাসের একটি বাক্সের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

প্রফেসরের সাথে থাকা দ্বিতীয় ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, “এখান থেকেই চুরি হয়েছে জিনিসটি?”

প্রফেসর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, “হ্যাঁ, এই বক্সের ভিতরেই ছিল সেটি। হাইলি প্রোটেক্টেড চেম্বার এটা, আমরা এই কয়েকজন ছাড়া আর কারোর ঢোকার পারমিশন নেই এখানে। সুপারগ্লাসের এই বক্সের চারপাশে সবসময় আল্ট্রা হাই-এনার্জি লেসার কভার থাকে, এছাড়াও পুরো চেম্বারটার বাইরে এ.আই. রোবট গার্ডের ব্যবস্থা আছে। এই জায়গা পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত আর গোপন স্থান; এখান থেকে কিভাবে যে এটা সম্ভব হল আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না!”

ওপর ব্যক্তি বাক্সটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা প্রফেসর, জিনিসটার ব্যাপারে একটু খুলে বলুন তো।”

প্রফেসর হিউনেস বললেন, “জিনিসটা খুব বেশি বড় নয়, ৫ সেন্টিমিটার রেডিয়াসের একটি কালো বলের মতোই দেখতে, তবে মোটেই সাধারণ নয়। ওটা আসলে একটা ব্ল্যাকহোল ইনিশিয়েটর; মানে এমন একটা যন্ত্র যা ব্যবহার করে ব্রহ্মান্ডের যেকোনো জায়গায় ব্ল্যাকহোল তৈরী করা যায়। বুঝতেই পারছেন, এটা যদি কোনো সৌরজগতের কাছাকাছি এপলাই করা হয় তবে ওই পুরো সৌরজগৎ ঢুকে যাবে ব্ল্যাকহোলের মুখে। জিনিসটা খুবই ভয়ানক এজেন্ট-বি, যদি ভুল হাতে পড়ে তবে মহা সর্বনাশ হতে পারে।”

এজেন্ট-বি এতক্ষণ চেম্বারের এদিকসেদিক ঘুরে দেখছিলেন; একটু থেমে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হুম, বুঝলাম। ব্যাপারটা বেশ চিন্তার। তা সিকিউরিটি ক্যামেরায় কিছুই ধরা পড়েনি?”

প্রফেসর মাথা নেড়ে বললেন, “সেটাই তো আরো চিন্তার কথা। পৃথিবীতে এমন কোনো টেকনোলজি নেই যা দিয়ে এই গোপন রিসার্চ সেন্টারের ক্যামেরা বা রোবটদের হ্যাক করা যায়; অথচ সেটাই হয়েছে। আমি আপনাকে ক্যামেরা ফুটেজ দেখাচ্ছি......”, বলেই প্রফেসর হাত তুলে তর্জনীটা হাওয়ায় ডানদিক থেকে বামদিকে একবার চালালেন, অমনি চোখের সামনে ভেসে উঠল ত্রিমাত্রিক বায়ো-সেনসিবল ভিডিও পর্দা; ছবিতে ডানদিকে আজকের তারিখ, ১৩ জানুয়ারী ৩০৩৭, সময় ১০:২৩ এ.এম.। সুন্দরভাবেই সবকিছু এগোল ১১ টা ৩১ মিনিট অবধি, তারপর হঠাৎ থেমে গেল ভিডিও, প্রায় ৫ মিনিট থেমে রইল ওভাবেই। আবার ১১ টা ৩৬ থেকে ভিডিও চলতে শুরু করল, আর ওইসময় থেকেই দেখা গেল বাক্সটা ভাঙা, ব্ল্যাকহোল ইনিশিয়েটরটাও গায়েব!

বেশ মনোযোগ দিয়েই ভিডিওটা দেখল এজেন্ট-বি, “আচ্ছা, প্রফেসর আপনি কিভাবে বুঝলেন যে ক্যামেরা বা রোবটগুলোকে হ্যাক করা হয়েছিল? মানে আমি জানতে চাইছি এটা কি শুধুই অনুমান না কোনো সাইবার এক্সপার্ট পরীক্ষা করে দেখেছেন?”

হিউনেস তার এক সহকর্মীর দিকে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে একবার তাকিয়ে বললেন, “না, এক্সপার্ট রিপোর্ট নয়, ওই ভিডিও থেমে যাওয়া দেখেই আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে হ্যাক করা হয়েছে।”

এজেন্ট-বি ভুরু কুঁচকে একবার তাকালেন প্রফেসরের দিকে, “অনুমানের ভিত্তিতে আমি কেস সলভ করি না প্রফেসর। আপনি এক্ষুণি একজন সাইবার এক্সপার্টকে ডাকুন আর আমি ততক্ষণে অন্য একটা কাজ সেরে রাখি।”

হিউনেসের এক সহকর্মী তখনি টেলিপ্যাথিক মেসেজ পাঠালেন একজন সাইবার এক্সপার্টকে। এদিকে এজেন্ট-বি নিজের পকেট থেকে একটা ছোট্ট টর্চের মতো যন্ত্র বের করে ভাঙা বাক্সটার পাশে রাখলেন, তার সামনেই হাওয়ায় একটা ফোটোনিক বায়ো-সেনসিবল কীবোর্ড দেখা দিল। কীবোর্ডে কিছু বোতাম টিপলেন এজেন্ট-বি, আর সাথে সাথে সেই টর্চের মতো জিনিসটার মুখ থেকে একটা হালকা গোলাপি আলোর ঝলকানিতে সারা ঘর ভরে গেল।

প্রফেসর বেশ অবাক ভাবেই তাকিয়ে ছিলেন যন্ত্রটার দিকে, “এটা কি কোনো ডিটেক্টর?”

এজেন্ট-বি যন্ত্রটার দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলেন, “ঠিক ডিটেক্টর নয়, কালেক্টর বলতে পারেন। প্রতিটা জীবন্ত বস্তুর দেহে কার্বন-১৪ থাকে, যা রেডিওএক্টিভ। সেই ডাটা কালেক্ট করে এই যন্ত্র, পরে খুব সহজেই সেটা থেকে ডি.এন.এ-র গঠন এবং সে কোন প্রজাতির জীব সবকিছুই বলে দেওয়া যায়। আমার মাথায় একটা সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে প্রফেসর, তাই এই ডাটাটা নিয়ে রাখলাম।”

কথা শেষ হতে না হতেই সাইবার এক্সপার্ট ডক্টর স্মিথ এসে ঢুকলেন চেম্বারে।

তার দিকে এগিয়ে গেলেন প্রফেসর হিউনেস, “আসুন আসুন ডক্টর স্মিথ, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

ডক্টর স্মিথ বেশ গম্ভীরভাবেই বললেন, “আমি শুনেছি ব্যাপারটা। চলুন ভিডিওটা দেখি একবার।”

বায়ো-সেনসিবল ভিডিও পর্দায় বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলেন ডক্টর স্মিথ, ক্রমশ উনার কপালের ভাঁজগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।

“কি বুঝছেন ডক্টর?” উৎকণ্ঠিত গলায় প্রফেসর হিউনেসের প্রশ্ন।

ডক্টর স্মিথ বার-দুয়েক মাথা চুলকে বললেন, “এমন জিনিস আমি আমার চৌত্রিশ বছরের কর্মজীবনে কখনো দেখিনি। আমি একশভাগ নিশ্চিত যে ক্যামেরা আর রোবটগুলোকে হ্যাক করা হয়নি; কিন্তু তবু যে কিভাবে ওই ভিডিওটা পাঁচ মিনিট থেমে রইল কিছুই বুঝতে পারছি না।”

এজেন্ট-বি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি পুরোপুরি নিশ্চিত যে এটা হ্যাকিং এর কেস নয়?”

আড় চোখে একবার তাকালেন ডক্টর স্মিথ, “হ্যাঁ মশাই, আমি লিখে দিতে পারি যে এটা হ্যাকিং নয়। কিন্তু কিভাবে করা হয়েছে তা আমার বুদ্ধির বাইরে। আচ্ছা আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?”

হিউনেস মধ্যস্থতা করলেন, “ডক্টর, ইনি হলেন এজেন্ট-বি। এফ.বি.আই এর সেরা গোয়েন্দা। উনিই কেসটা দেখছেন।”

“আচ্ছা, আমি আপাতত চলি প্রফেসর, কোনো প্রয়োজন হলে আপনাকে টেলিপ্যাথি করে নেব”, নিজের টর্চের মতো যন্ত্রটা পকেটে পুরে বেরিয়ে পড়লেন এজেন্ট-বি।

পরদিন সকালে হঠাৎ একটা টেলিপ্যাথিক মেসেজ এল হিউনেসের কাছে; মেসেজ রিসিভ করতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এজেন্ট-বি’র মুখ, “প্রফেসর, আপনি এক্ষুণি একবার এফ.বি.আই এর ল্যাবে আসুন।”

তড়িঘড়ি নিজের জেট-বাইক নিয়ে ছুটে গেলেন হিউনেস, ল্যাবে ঢুকেই এজেন্ট-বি কে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার? কিছু ধরতে পারলেন?”

“না, ধরতে পারিনি, তবে একটা পথ পেয়েছি।” বলে একটু মুচকি হাসলেন এজেন্ট-বি।

প্রফেসরের ঠিক সামনে এজেন্ট-বি একটি বায়ো-সেনসিবল স্ক্রিন খুলে ধরলেন, “এই দেখুন, ডি.এন.এ রিপোর্ট।” পর্দায় বেশকিছু লেখা ভেসে উঠল। এজেন্ট-বি ডাটাগুলো স্ক্রল-ডাউন করতে করতে বললেন, “আপনাদের ওই চেম্বারে মোট ছয় রকম ডি.এন.এ পাওয়া গেছে। তিনটি আপনার তিনজন সহকর্মীর, একটি আপনার আর একটি আমার। কিন্তু আসল ব্যাপারটি হল ওই ছয় নম্বর ডি.এন.এ-টি নিয়ে। ওটি পৃথিবীর কোনো জীবের মোটেই নয়, রেকর্ড বলছে এটি জাকুটা গ্রহের মানুষের ডি.এন.এ।”

দু’চোখ ছানাবড়া করে প্রফেসর বললেন, “বলেন কী? জাকুটা! সে তো পৃথিবী থেকে ৪০২২ আলোকবর্ষ দূরে।”

“হুম, সময় নেই এক্ষুণি বেরোতে হবে। আপনিও চলুন প্রফেসর, ওই ব্ল্যাকহোল ইনিশিয়েটর নিয়ে কোনো প্রব্লেম হলে আপনাকেই সামলাতে হবে”, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন এজেন্ট-বি।

হিউনেস তখনও শঙ্কিত মুখে বসে আছেন, “আরে মশাই ৪০২২ আলোকবর্ষ যাবেন কিভাবে?”

এবার এজেন্ট-বি একটু হাসলেন, “আরে মশাই, সাধে কি এফ.বি.আই ল্যাব খুলে বসেছে? এই যে দেখুন, এখান থেকে ঠিক ২৫ ডিগ্রি ২১ মিনিট ১৩ সেকেন্ড কোণে এক আলোকবর্ষ দূরে একটা ওয়ার্ম হোল আছে, আর.এস-১৪১ ইনোভা, তার মুখ গিয়ে খোলে সোজা ওই জাকুটা গ্রহের সামনে; বেশি নয়, আলোর বেগের ০.৮৩ বেগে এগোলে মাত্র দুইমাস লাগবে ওয়ার্মহোল দিয়ে জাকুটা পৌঁছতে।”

এবার একটু আশ্বস্ত হলেন হিউনেস, “আচ্ছা, যাক তাহলে তো যাওয়াটা কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু আরেকটা কথা মাথায় আসছে।”

এজেন্ট-বি টেবিলের উপর ঝুকে বললেন, “এটাই তো যে ওই ভিডিওতে সময় থামল কিভাবে?”

“হ্যাঁ, একদম ঠিক ধরেছেন।”

“সত্যি বলতে কি প্রফেসর, এই ব্যাপারটা আমারও ঠিক মাথায় ঢুকছে না। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে জাকুটা গেলে এটার জবাবও নিশ্চয়ই পেয়ে যাব।”

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক সরঞ্জাম সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন এজেন্ট-বি আর প্রফেসর হিউনেস। সিলিকন ফাইব্রো-কার্বাইডের সুপারফাস্ট স্পেসশিপ নিয়ে রওনা দিলেন দুজনে। প্রায় দু’বছরের মাথায় তাদের স্পেসশিপ ওয়ার্মহোলের তীব্র মাস-এনার্জি ট্রান্সফরমেশন সয়ে গিয়ে পৌঁছল জাকুটার সামনে।

হিউনেস বললেন, “শিপ নামাবেন না?”

“নামাবো প্রফেসর, কিন্তু এতো বড় গ্রহে যেখানে সেখানে নামিয়ে কোনোদিনই খুঁজে পাব না চোরের সন্ধান। তাই আগে গত পাঁচ বছরের টাইম-ভিউ দেখতে হবে। মানে গত পাঁচ বছরে ক’খানা স্পেসশিপ এই ওয়ার্মহোলের দিকে এসেছে আর গ্রহের কোন অংশ থেকে এসেছে, এই দুটোই জানা খুব দরকার।”

কথামত টাইম-ভিউ স্ক্রিন অন করা হল, প্রায় আধঘন্টা পর হঠাৎ তাদের নজরে এল চার বছর আগে, মানে ১৩ জানুয়ারী ৩০৩৭ এর ঠিক দু’বছর আগে জেড-৫০৪ নম্বরের একটি স্পেসশিপ এই ওয়ার্মহোলের দিকে এগিয়েছিল।

এজেন্ট-বি প্রফেসরের কাঁধে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে উঠলেন, “এই দেখুন প্রফেসর, এই সেই শিপ। গ্রহের দক্ষিণ-পূর্বে ১৩ ডিগ্রি ৪১ মিনিট ০৩ সেকেন্ড থেকে উড়েছিল। ওখানেই আমরাও স্পেসশিপ নামাবো।”

মিনিট দুয়েক লাগল স্পেসশিপ নামাতে। একটি পাহাড়ের পেছনে নামল ওরা, সাথে সাথেই ইনভিসিবিলিটি ফাঙ্কশন চালু করে অদৃশ্য করে দিল স্পেসশিপটি, নজর এড়ানোর জন্যেই এই ব্যবস্থা।



“দাঁড়ান প্রফেসর, এভাবে লোকজনের সামনে গেলে বিপদে পড়তে পারি। যেমন দেশ, তার তেমন বেশ!” বলেই স্পেসসুইটের বাঁদিকে একটা বোতাম টিপলেন এজেন্ট-বি। মুহূর্তের মধ্যে রূপ পাল্টে গিয়ে গায়ের রং গাঢ় সবুজ হয়ে উঠল, হাতে লম্বা লম্বা তিনটে আঙ্গুল, তাদের ডগাটা আবার একটু ফোলা। কান আর নাকের জায়গায় শুধু দুটো ছিদ্র, চোখগুলো কুচকুচে কালো, জ্বলজ্বল করছে। প্রফেসরও একই ভাবে বোতাম টিপে নিজের রূপ পাল্টে নিলেন। জাকুটা গ্রহের লোকেরা এমনটাই হয় দেখতে। এই নতুন রূপে দুজনে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন লোকালয়ের দিকে।

কিন্তু লোকালয়ে ঢুকেই তো ওদের চক্ষু চড়কগাছ! এতোদূর আসা সবই কি তবে জলে গেল! এই গ্রহের সভ্যতা যে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে, এখান থেকে স্পেসশিপ আসা অসম্ভব। এরা তো এখনো গাড়ির যুগেই পা রাখেনি। কিন্তু টাইম-ভিউ তো স্পষ্ট দেখাল যে চার বছর আগে এখান থেকেই একটি স্পেসশিপ ওয়ার্মহোলে ঢুকেছে।

দুজনেই হতবাক হয়ে একে ওপরের দিকে চেয়ে আছে, এমন সময় হঠাৎ হিউনেসের চোখে পড়ল দূরে কিছু লোক মাটির স্পেসশিপের মত কি যেন একটা বানিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। কাছে গিয়ে জানা গেল বছর চারেক আগে হঠাৎ নাকি এরকম একটা জিনিস এখানে আবির্ভূত হয়ে আকাশে উড়ে গেছিল। এখানে লোকেদের ধারণা এটি কোনো দেবতার রথ!

এজেন্ট-বি নিজের বাঁ-হাতের তালুতে কষিয়ে এক ঘুষি মেরে বললেন, “উফ, এই জিনিসটা আগে কেন মাথায় আসেনি আমার!”

অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন হিউনেস, “কি জিনিস এজেন্ট-বি?”

“বুঝতে পারছেন না প্রফেসর? টাইম-ট্রাভেল! আর তাই আপনার চেম্বারের ক্যামেরা, রোবট সবকিছুই থেমে গেছিল তখন।”

“আপনি কি বলছেন এজেন্ট-বি, আমি এখনো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

প্রফেসর হিউনেসকে সাথে নিয়ে লোকজনের ভিড় থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন এজেন্ট-বি, “শুনুন তবে, সব খুলে বলছি আপনাকে। আপনাদের ভিডিও ক্যামেরাগুলো হ্যাক হয়নি অথচ থেমে গিয়েছিল, এটা তখনি সম্ভব যখন টাইম-ওভারল্যাপ হয়। মানে ওই চেম্বারে এমন কেউ একজন ঢুকেছিল যে এই সময়ের নয়, খুব সম্ভবত ভবিষ্যতের লোক। এখানে এসে এদের স্পেসশিপ পুজো দেখে যা আন্দাজ করতে পারছি তা অনেকটা এরকম....... ভবিষ্যতের জাকুটা গ্রহ থেকে কেউ একজন টাইম-ট্রাভেল করে প্রায় চার বছর আগে এখানে, মানে বর্তমানের এই জাকুটা গ্রহে আসে। তারপর এখান থেকে ওর আরো দু’বছর লাগে ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আসতে। সেখান থেকে ব্ল্যাকহোল ইনিশিয়েটরটা চুরি করে আবার এখানে ফিরে আসে এবং টাইম-ট্রাভেল করে ভবিষ্যতে মানে ওর নিজের সময়ে ফিরে যায়।”

এতক্ষণ অবাক এ শুনছিলেন প্রফেসর হিউনেস, এবার মুখ খুললেন, “বাপ রে! আপনি তো জিনিয়াস মশাই, কেসটা ধরে ফেলেছেন এতো সহজে।”

“এখনও অনেক বাকি প্রফেসর, এবার টাইম-ট্রাভেল করতে হবে। ওই ভবিষ্যতের জাকুটাবাসী আমাদের থেকে মাত্র একদিন এগিয়ে আছে।”

“টাইম-ট্রাভেল!! কিন্তু বুঝবেন কিভাবে যে কোন সময়ে যেতে হবে?”

“উপায় আছে প্রফেসসরবাবু। ওই দেখুন, ওদের মাটির স্পেসশিপটার উপরে একটা প্লাস্টিকের টুকরো লাগানো আছে, এটা নিশ্চয়ই ওই আসল স্পেসশিপ থেকে পড়েছে; কারণ এই জিনিস এরা এখনও তৈরী করতে শেখেনি।”

“কিন্তু ইয়ে, মানে বলছিলাম, যখন জিনিসটা অন্য সময়ে চলে গেছে, তখন আর ওটাকে নিয়ে ভাবার কি কোনো দরকার আছে? ওটা থেকে আমাদের তো আর কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই।”

“কি বলছেন প্রফেসর? এতদূর এসে খালি হাতে ফিরে যাব? এজেন্ট-বি আজ অবধি কোনো কেস মাঝপথে ছাড়েনি, এটা মনে রাখবেন।”

অগত্যা প্রফেসর হিউনেসকেও এজেন্ট-বি’র সাথেই এগোতে হল। স্লিপিং-রে দিয়ে আশেপাশের লোকেদের অজ্ঞান করতে বেশি সময় লাগল না, আর তারপর সহজেই ওদের হস্তগত হল সেই প্লাস্টিকের টুকরো। স্পেসশিপের কাছে ফিরে গেল দুজনে, সেখানেই টাইম-ট্রাভেলিং ওয়াচ হাতে পরে নিল ওরা। ওই প্লাস্টিকের টুকরোটির রেডিও-স্ক্যানিং করে দেখা গেল জিনিসটি এখন থেকে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ বছর পরের।

টাইম-ওয়াচে সঠিক দিনক্ষণ ইনপুট করে দেওয়া হল। ওদের প্ল্যান ছিল, অদৃশ্য হয়ে টাইম-ট্রাভেল করে ভবিষ্যতে যাবে এবং সেই ইনিশিয়েটর খুঁজে আবার এখানে ফিরে আসবে, আর তারপর স্পেসশিপ নিয়ে ফিরে যাবে পৃথিবীতে।

পরিকল্পনা মতোই এগোল দুজনে, টাইম-ট্রাভেল করে নিমেষে গিয়ে হাজির হল সেই অজানা ভবিষ্যতের মাটিতে। বিশাল মহানগরী, পুরোটাই ভাসছে হাওয়ায়! এমন আরো কত সব আধুনিক জিনিস রয়েছে এখানে। ভাবতেই অবাক লাগে এই একই জাকুটা গ্রহে একটু আগে ওরা স্পেসশিপকে দেবতা জ্ঞানে পূজিত হতে দেখে এসেছে।

ওরা দুজনেই অদৃশ্য, তাই কেউ দেখতে পাবার চিন্তা নেই। কিন্তু হঠাৎ কিছু অস্ত্রধারী লোক এসে ওদের ঘিরে ধরল, তাদের একজন ইউনিভার্সাল ট্রান্সলেটর ব্যবহার করে পৃথিবীর ভাষাতেই বলল, “তোমরা অদৃশ্য হয়ে আছ আমরা জানি, এই মুহূর্তে যদি ইনভিসিবিলিটি ফাঙ্কশন অফ না কর তবে এই হাই-এনার্জি লেসার-গান দিয়ে ঝলসে দেব।”

এরা ঠিক কিভাবে যে টের পেল তা কিছুই বুঝতে পারলেন না এজেন্ট-বি ও প্রফেসর হিউনেস, কিন্তু উপায়ান্তর না থাকায় দুজনকেই ভিসিবল হয়ে ধরা দিতে হল। সঙ্গে সঙ্গে ওই অস্ত্রধারী জাকুটাবাসীরা ওদের একটি ছোট জেট-কারে তুলে নিল, উচ্চ বেগে ছুটে চলল গাড়ি। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না এজেন্ট-বি, প্রফেসরও ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছেন। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাটল। তারপর ওদের এক অন্ধকার ঘরে নিয়ে গেল দুজন অস্ত্রধারী; একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। মিনিট পনেরো পরে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল, এজেন্ট-বি চেয়ারে বসে আছেন, হাত-পা বাঁধা। তার উল্টোদিকে বসে আছে একজন জাকুটাবাসী, আর দুজন অস্ত্রধারী তার দুপাশে দাঁড়িয়ে। এজেন্ট-বি’র সামনে টেবিলের ওপর রাখা একটি কালো বল; এই কি তবে সেই ইনিশিয়েটর?

চেয়ারে বসা সেই জাকুটাবাসী বেশ কর্কশ স্বরে বলল, “কি দেখছ? ঠিকই ভাবছ, এটাই সেই ব্ল্যাকহোল ইনিশিয়েটর যার জন্যে এতো দূর এসেছ তুমি।”

হঠাৎ এজেন্ট-বি খেয়াল করল প্রফেসর হিউনেসকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, “একি, প্রফেসর হিউনেস কোথায়? কি করেছ ওর সাথে তোমরা?”

সেই জাকুটাবাসীর বিকট হাসিতে গমগম করে উঠল ঘরখানা; পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে সে ডাকল, “প্রফেসর হিউনেস, আপনার বন্ধু আপনাকে খুঁজছে।”

এবার এজেন্ট-বি’র অবাক হবার পালা; ঘরের পেছনের বায়ো-পারমিয়েবল গ্লাসের দরজা দিয়ে লেসার-গান হাতে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর হিউনেস, ঠোঁটে তার কুটিল হাসির রেখা।

হিউনেস বললেন, “কি হল এজেন্ট-বি, বুঝতে পারছ না? তুমি সত্যিই জিনিয়াস, এতদূর যে পৌঁছতে পারবে আমি ভাবিনি। খোলসা করে বলি, শোনো। এদের কাছে ব্ল্যাকহোল ইনিশিয়েটরটা আমিই বিক্রি করেছি। তোমার ক্যামেরা থেমে যাওয়ার তত্ত্ব একদম নির্ভুল, কিন্তু চেম্বারের গেটগুলো আমিই খুলে দিয়েছিলাম। জিনিসটা যেহেতু সরকারি, তাই তদন্ত হবে জানতাম, জাকুটা অবধি পৌঁছবে আশা করেছিলাম, কিন্তু টাইম-ট্রাভেলের ব্যাপারটাও যে ধরে ফেলবে তুমি, তা ভাবতে পারিনি। তাই তখন নাও করেছিলাম, কিন্তু তুমি শোনোনি।”

“ছিঃ প্রফেসর, আপনি যে এতটা নিচে নামবেন ভাবতে পারিনি।”

“আর বেশি ভেবে লাভ নেই এজেন্ট-বি, এবার ঘুমিয়ে পড়।”

কথা শেষ হতে না হতেই হিউনেসের লেসার-গান থেকে বেরোনো হাই-এনার্জি রে এসে ঝাঁঝরা করে দিল এজেন্ট-বি’র বুকের পাঁজর, চেয়ারেই লুটিয়ে পড়ল দেহ। চেয়ারে বসা সেই জাকুটাবাসীর নির্দেশে এগিয়ে এল দুই অস্ত্রধারী, ধীরে ধীরে এজেন্ট-বি’র হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে লাগল তারা, বাইরে নিয়ে ফেলতে হবে লাশটা। কিন্তু পায়ের শেষ বাঁধন খুলতেই হঠাৎ বিদ্যুৎ বেগে উঠে দাঁড়ালেন এজেন্ট-বি, ক্ষিপ্রহস্তে কেড়ে নিলেন অস্ত্র, নিমেষে শেষ হয়ে গেল তিন জাকুটাবাসী।
কিছু বুঝে উঠার আগেই লেসার-গানের মুখ হিউনেসের দিকে তাক করে ধরলেন এজেন্ট-বি, “একটু ভুল করে ফেললেন প্রফেসর। আমি এফ.বি.আই এর লোক, আমাদের দেহের কোষ জেনেটিক্যালি মডিফাইড, আল্ট্রা হাই-এনার্জি লেসারও সহজেই সয়ে যেতে পারে, এটা তো মোটে হাই-এনার্জি রেঞ্জের লেসার।”

হিউনেসের মুখ শুকিয়ে গেল, কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাকে অনেক টাকা...”

কথা শেষ করার আগেই সাঁই করে লেসার রে এসে লাগল প্রফেসরের কপালে, মাথা ফুঁটো করে বেরিয়ে গেল রে; “সরি প্রফেসর, আমি বেইমানদের ক্ষমা করি না!”, বলতে বলতে বন্দুকটা নামিয়ে টেবিলে রাখলেন এজেন্ট-বি।

টেবিলের ওপর রাখা ব্ল্যাকহোল ইনিশিয়েটরটা হাতে তুলে নিলেন; নিরেট কালো একটা বল আর গোয়েন্দার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।

অলংকরণ - সুপ্রিয় দাস