অন্তর্দহন

অনিমেষ গুপ্ত

শোকের ছায়া লেগে থাকলেও অনেকের হৈ-হট্টগোল আর কথাবার্তায় ক’টাদিন সরগরম ছিল বাড়ীটা। শ্রাবণীই বরং একটু স্পেস চাইছিল একলা হওয়ার জন্য, চাইছিল প্রবালের স্মৃতিতে ডুবে থাকতে।

শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটে যাওয়ার পরে হঠাৎই খালি হয়ে গেল বাড়ী। শুধুমাত্র ঝুনুপিসি আর লতিকামাসী আরো আধবেলা থেকে শ্রাবণীর জিনিসপত্র একটু গোছগাছ করে ফিরে গেলে ওপর-নীচে দুটোতলার মাঝে বড় ধাপের ঘোরালো সিঁড়ি, ছোট বড় পাঁচটা ঘর আর প্রবালের ছেড়ে যাওয়া মাঝ দুপুরের শূন্যতার মধ্যে শ্রাবণী তখন একেবারে একা।


খানিকক্ষণ আনমনে সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করার পরে যে কান্না আটকে রেখেছিল এতদিন, তাই যেন অঝোরে নেমে এল শ্রাবণীর দুচোখ বেয়ে। একসময় চোখ শুকিয়ে গেলেও একধরণের উদাস আর বুক খালি করা ভাব নিয়ে স্টাডিরুমে প্রবালের ব্যবহার করা জিনিষগুলোর ওপরে হাত বোলাতে বোলাতে হঠাৎই ওয়ারড্রোবের সঙ্গে অ্যাটাচড ছোট ড্রয়ারটার মধ্যে রাখা খয়েরী রঙের ডায়েরীটা নজরে পড়ল শ্রাবণীর। সাধারণ কৌতূহলে ডায়েরীর মলাট উল্টিয়ে ভেতরে তাকাতেই চমকে উঠল সে। পাতায় পাতায় অদ্ভুত বর্ণনায় ক্যানসারের মতো মারক রোগের যন্ত্রণার কথা আর তার মাঝে মাঝে চিরকালের মত শ্রাবণীকে হারানোর আশঙ্কার কষ্ট এমন ভাবে লেখা যে পড়তে পড়তে দম বন্ধ হয়ে আসে। চোখের জলে অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে আসতে আবেগের বশে ডায়েরীটা হঠাৎ বন্ধ করতে হলুদ হয়ে আসা একটা ভাঁজ করা পুরনো কাগজ ডায়েরীর ভেতর থেকে নেমে এসে পড়ল শ্রাবণীর কোলের ওপর। বহুকাল আগের এক ছোট্ট চিঠি...

ঝিনুক,

অনেক চেষ্টা করেও এই চিঠি লেখা থেকে নিজেকে আটকাতে পারলাম না। তোমাকে দেখার পর থেকেই মনে হচ্ছে যেন কতদিন আগে থেকে চিনি। বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়! জানি না তুমি কি ভাববে! তোমার উত্তর জানিয়ো। অপেক্ষায় থাকবো।

ইতি, প্রলয়।

চিঠিটা নতুন করে পড়তে পড়তে স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়া প্রলয় নামের সেই অন্ধকার মুখ শ্রাবণীকে পৌঁছে দিল আসানসোলের ছোট্ট কলোনী মহিশীলায়। ষোল বছরের শ্রাবণী তখন বন্ধুদের প্রিয় ‘ঝিনুক’।

প্রথম প্রেমপত্র পাওয়ার সঙ্গে লেগে থাকা অচেনা আতঙ্কে সেদিন চিঠিটা প্রলয়ের গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে পালিয়ে এসেছিল ঝিনুক। এক অন্য ধরণের শিরশিরানি, বুক ঢিপঢিপ করা ভয় আর উন্মনা ভাব নিয়ে ফিরে এসে বাড়ী-বন্দী করেছিল নিজেকে। বাবা-মা আর বন্ধুদের জেদাজিদি সত্ত্বেও বেরোয়নি কোথায়। দিন পনেরো পরে যখন সাহস এল, শুনল প্রলয়রা চলে গেছে মহিশীলা ছেড়ে।

সেদিনের সেই অভিজ্ঞতা যেন অবহেলায় পড়া অক্ষরের মতই মিলিয়ে গিয়েছিল শ্রাবণীর স্মৃতি থেকে। বিয়ের অনেক পরে যখন সে জেনেছিল যে প্রবালের আরো একটা নাম আছে তার দিদিমা’র দেওয়া আর সে নাম ‘প্রলয়’, তখনো কোন প্রশ্ন জাগেনি তার মনে। তবু আজ এই থম-মারা দুপুরে হঠাৎ বের হয়ে আসা এই বিবর্ণ চিঠি প্রবাল সম্বন্ধে শ্রাবণীর মনে কতগুলো উত্তাল অথচ সরল জিজ্ঞাসার ঢেউ তুলল...

১) যত্নে এবং গোপনে রাখা এই চিঠির উপস্থিতিতে একথা কি স্পষ্ট নয় যে এতদিনেও প্রবাল ভোলেনি ঝিনুককে এবং সেকথা সে গোপন করে গেছে শ্রাবণীর থেকে!

২) প্রবাল কি শ্রাবণীকে ঝিনুক বলে চিনেছিল না কি শ্রাবণীর সঙ্গে ঘর করলেও শেষ অবধি তার মনে ঝিনুকের ছবিই উজ্জ্বল হয়ে ছিল!

প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একদিকে প্রবালের কষ্ট, শ্রাবণীর প্রতি তার ঘনিষ্ঠ আকর্ষণ আর অন্যদিকে প্রবালের কখনোই ঝিনুককে ভুলতে না পারা এবং প্রবালের অনুপস্থিতিতে এ প্রশ্ন চিরকালের মতো উত্তরহীন থেকে যাওয়া... এ দুয়ের টানাপোড়েনের মধ্যে দুলতে থাকা অসহায় শ্রাবণী কখনো বিস্ময়, কখনো হাসি কখনো বা সেই ষোল-কিশোরী ঝিনুকের ওপর এক অদ্ভুত হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকল।

অলংকরণ - ভ্যালেরি সার্গ (শাটারস্টক)