অমলের আর্তনাদ

কৃশানু চন্দ


জেল থেকে বেরোবার আগে অমল একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

২০৩৯ সাল। রাষ্ট্র সরকারের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভালো রাজ্যে আজ আলোর ঝলকানি।চারিদিকে বাজি পুড়ছে। কালো রাজ্য এবং ভালো রাজ্যের মাঝের ৫০ মিটার লম্বা কংক্রিটের পাঁচিলটা যেন দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ভালো রাজ্যেকে কালো শহরের কলুষতা থেকে রক্ষা করছে।


২০২৫ সালেই গোটা দেশে দুটি অংশে ভাগ করা হয়,একটি অংশ পুরোপুরিভাবে ডিজিটাল এবং অত্যাধুনিক। এখানে কোন রকম কলুষতা নেই, নেই দারিদ্র্যর মতো অসুখ, যারাই এখানে বসবাস করে প্রত্যেকেই সমাজের উন্নত জীব হিসেবে ধরা হয়। যেখানে সবকিছুই হয় ডিজিটালি। খাবার খাওয়া থেকে শুরু করে বংশ বিস্তার,সবকিছুই হয় আঙ্গুলের একটি মাত্র ছোঁয়ায়। এখানে যারাই বসবাস করে,তারা অসুখে ভোগেন না,তাঁদের বার্ধক্য আসে না। সবাই সেখানে বেঁচে থাকে,কারুর মৃত্যু হয় না। সবখানে শুধু শান্তি আর শান্তি।২০১৬ সালের যুগান্তকারী ৫০০-১০০০ টাকার নোটের বিলুপ্তির পর গোটা দেশ থেকে কালো টাকা সম্পূর্ণ ভাবে শেষ হয়ে যায়। দেশে এক অদ্ভুত অগ্রগতির জোয়ার আসে। প্রত্যেক মানুষের ব্যাংকে ১৫ লক্ষ টাকা আসে,যা পরে ভালো রাজ্যকে গঠন করতে বিশাল কার্যকরী হয়েছিল। সেই টাকা দিয়েই পরের দিকে নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে গোমূত্র দিয়ে এমন এক ওষুধ আবিষ্কার হয় যা মানুষকে বৃদ্ধ হওয়ার থেকে বাঁচায়, অমরত্ব দান করে। যাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল, যারা রাষ্ট্র সরকারের সুদূরপ্রসারী উন্নতির দিকটি ধরতে পেরেছিলেন এবং যাঁরা জীবনেও কোনদিন কোনরকম অনৈতিক কাজ করেননি, তাঁরাই ভবিষ্যতে স্থান পান ভালো রাজ্যে এবং আরও ধনীরা সেই সাথে লাভ করেন অমরত্ব।

আর একটি অংশে থাকেন তাঁরা, যাঁদের ২০১৬ সালের সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না, যাঁরা সব সময় নিজের কথা ভাবতেন রাষ্ট্রের কথা না ভেবে, যাঁরা রাষ্ট্র সরকারের প্রত্যেক ‘হ্যাঁ’তে ‘হ্যাঁ’ বলতে অস্বীকার করেন, তাঁদের জায়গা হয় কালো রাজ্যে। এখন এখানের অধিবাসীদের সমাজের অনুন্নত জীব বলে গণ্য করা হয়, চারিদিকে দারিদ্র্যর মতো ভয়াবহ অসুখ, বেশিরভাগ অঞ্চলেই বিদ্যুতের অভাব। এখানে যাঁরা বসবাস করেন,তাঁদের কেউই সমাজে প্রতিষ্ঠিত নয়, তাঁদের কাজ হল ভালো রাজ্যের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার উৎপন্ন করা, ভালো রাজ্যের বিদ্যুতের যোগানের জন্য কয়লাখনিতে দিনরাত পরিশ্রম, বলা যায় ভালো রাজ্যের মানুষের জীবন যাতে আরও মসৃণ হয়, তার জন্য হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। তবে তাঁদের খাটুনির পিছনে আশার আলো এটাই যে প্রত্যেক ১০ বছর অন্তর কিছু কালো রাজ্যের নিবাসী ভালো রাজ্যে যাওয়ার ছাড়পত্র পান। অবশ্য সে ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম আছে। যেমন—

#রাষ্ট্র সরকারের জন্য নিবেদিত প্রাণ হতে হবে। রাষ্ট্র সরকারের কোন কাজের বিরুদ্ধ মত হওয়া চলবে না। নিজের স্বার্থ ভুলে রাষ্ট্রের ভালোর দিকে মন দিতে হবে।

#রাষ্ট্রীয় প্রাণী অর্থাৎ গোমাংস কোনদিনও স্পর্শ করা চলবে না, করলেই মৃত্যুদন্ড।

#সমস্ত জিনিস যা ডিজিটাল নয় যেমন আবেগ-ভালোবাসা-যুক্তি ইত্যাদি বর্জন করতে হবে। বইপত্র-লেখাপড়া-রন্ধন-কৃষি ইত্যাদি কালো রাজ্যের প্রতীকগুলি ভালো রাজ্যে বেআইনি।

এইরকম আরও ১০-১৫ টি কঠিন নিয়ম মানতে পারলে তবেই ভালো রাজ্যে স্থান পাওয়া সম্ভব। কালো রাজ্যের অধিবাসীরা তাই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শুধু পরিশ্রম করে যায় ভালো রাজ্যের মধ্যে থাকার আকাঙ্ক্ষায়। তারা জানে ভালো রাজ্যে কোনরকম দারিদ্র্য নেই। সবাই পেট ভরে খেতে পায়, সবার শান্তিতে ঘুম হয়। কোন দুঃখ নেই, কোনো কষ্ট নেই, সবাই সেখানে গেলে অমরত্ব লাভ করে। তাই তারা আশায় বুক বাঁধে, কবে এই ভঙ্গুর কালো রাজ্যের কলুষতা পেরিয়ে তাঁরা প্রবেশ করবেন ভালো রাজ্যে।

অমলও ছিল তাদেরই মধ্যে একজন। কালো রাজ্যের বাসিন্দা,একটি গোয়াল ছিল তার, ভালো রাজ্যের নানা ধরনের খাবারের যোগানের জন্য উৎকৃষ্ট মানের চিজ, মিষ্টি, রাবড়ি, মিহিদানা তৈরি করত। তবে আসল হাত ছিল দইয়ে। তার দইয়ের চাহিদা ছিল আকাশ ছোঁয়া। এই করে করে অমলের খ্যাতি কালো রাজ্য ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে ভালো রাজ্যেও পৌঁছে গেছিল। বেশ কিছু ভালো রাজ্যের অধিবাসীর সহায়তায় এবং রাষ্ট্র সরকারের একনিষ্ঠ ভক্ত হওয়ার সুবাদে একদিন সে ভালো রাজ্যে যাওয়ার ছাড়পত্র পেল। জীবনের একমাত্র স্বপ্ন যে এমনভাবে সত্যি হবে সে ভাবেনি। নিজের সমস্ত বিষয় সম্পত্তি বেঁচে সে প্রচুর নগদ টাকা জোগাড় করল। ভালো জামাকাপড় কিনল, দারুণ ভাবে স্নান করল (কালো রাজ্যে স্নান করার নিয়ম নেই, পৃথিবীর জলস্তর বহু নীচে, তাই একমাত্র ভালো রাজ্যের মানুষরাই এই সুবিধে ভোগ করতে পারে), ফিটফাট করে তৈরী হয়ে জামাকাপড়ের ব্যাগ ও টাকার থলে নিয়ে রওনা ভালো রাজ্য এবং কালো রাজ্যের পাঁচিলের সীমানায়। কিন্তু অতি উৎসাহে অমল এমন একটি জিনিস সাথে নিয়ে ফেলল যা ওর ভাগ্য নির্ধারণ করে দিল।

অনেকটা পথ পেরিয়ে যখন ভালো রাজ্য ও কালো রাজ্যের পাঁচিলের গেটের কাছে অমল পৌঁছেছিল তখন বিকেল হয় হয়। চারিদিকে সুরক্ষা বলয়।চতুর্দিকে ক্যামেরা এবং মেশিনগান নিয়ে প্রহরা দিচ্ছে সৈন্য। বিশাল বড় অফিসের মধ্যে ঢোকার পর অমলের কাগজপত্র দেখা শোনা শুরু হল, শুরু হল সুরক্ষা তল্লাশি। ব্যাগ এবং থলে চলে গেল এক্স রে ট্রেতে। সুরক্ষা তল্লাশি শেষ হতে অমল অপেক্ষা করছিল ব্যাগগুলোর। জানলার বাইরের আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ গুলো দেখে অমল তার ছেঁড়া শৈশব কথা ভাবতে শুরু করল। তার মনে আসল কিভাবে তাঁর দাদু তাঁকে গরুদের সাথে বন্ধুত্ব করতে শিখিয়েছিলেন, কিভাবে প্রত্যেকদিন দাদু তাঁকে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়েছিলেন, নজরুলের গান, শ্যামা সংগীত ইত্যাদি শুনিয়ে বড় করিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন জীবনের আদর্শ বোধ,চিনিয়েছিলেন বিবেককে। কিন্তু কঠিন অসুখ কিভাবে তাকে আলাদা করে দিয়েছিল তার দাদুর সাথে। মৃত্যুপথযাত্রী দাদুকে দেখেই অমল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কোনদিনও সে মরবে না। চির জীবন বেঁচে থাকার জায়গা একটাই, সেটা ভালো রাজ্য। তাই ছোটো থেকেই পরিশ্রমকে বন্ধু করে আজ সে মুক্তির দোরগোড়ায়, অবশেষে মৃত্যুকে সে মাত দিতে পারবে। ভাবতে ভাবতেই তার চোখে জল চলে আসে।

আচমকা একটা চিৎকারে তার সম্বিত ফিরল। অমল হঠাৎ দেখল সব সৈন্যরা তার দিকেই বন্দুক তাক করে আছে। অমল কিছু বোঝার আগেই ওর হাত বেঁধে ফেলা হল। অমল এতটাই অবাক হল যে কিছু বলতেই পারল না। তক্ষুনি দেখল এক্স রে ট্রে থেকে সুরক্ষা বলয়ের এক কর্মী গ্লাভস হাতে একটা জিনিস অমলের ব্যাগ খুলে বের করল। বের করেই সেটা অমলের পায়ের সামনে রেখে জিজ্ঞেস করল,

—“এটা আপনার?”

অমল ঝাপসা চোখে দেখল একটা বই।

শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত...

অমল অস্পষ্ট ভাবে বিড়বিড় করে কিছু বলে মাথা নাড়ল।

১ বছর পর জেল থেকে বেরোবার আগে এসে অমল একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু যেই জেল থেকে বেরোল, অমলের চোখ ঝলসে গেল। চারিদিকে শুধু আলো আর আলো। এত আলো অমল জীবনেও দেখেনি। দেখল রাত ১টা বাজে, অথচ শহরের চারিদিকে শুধু আলো আর আলো, অমলের বুঝতে অসুবিধে হল না, ও ভালো শহরে পৌঁছে গেছে। আনন্দে মন নেচে উঠল অমলের। আস্তে আস্তে হাতে জামাকাপড় আর টাকার থলে নিয়ে এগিয়ে চলল রাজপথ ধরে। একটা মোড় আসতেই দেখল বিশাল বহুতল বাড়ি, চারিদিকে শুধু আলো আর আলো। বিশাল সব টিভি স্ক্রীন চারিদিকে, কোথাও খেলা বা কোথাও খবর। অমল খবর দেখতে দেখতেই হঠাৎ তলার হেডলাইন পড়ার পর ওখানেই কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল।

“১৫ দিন হল রাষ্ট্র সরকার ২০০০ এবং ৪০০০ এর নোট গুলোর বাতিল করেছে। প্রচুর মানুষ রাষ্ট্র সরকারের এই সিদ্ধান্তে বাহবা দিচ্ছেন। তাঁদের মতে কালো ধন রোখার এর থেকে ভালো উপায় আগে কখনও হয়নি। যদিও এখনও কালো টাকা তেমন পাওয়া যায়নি, কিন্তু রাষ্ট্রগুরুর মতে শীঘ্রই এটা কার্যকর হতে শুরু করবে। দরকার হলে ট্রাম্পল্যান্ডের সৈন্যদের সাহায্য নেওয়া হতে পারে। অন্য খবরে, এই সিদ্ধান্তের ফলে কালো শহরের জনজীবন স্তব্ধ। অনেকেই অনাহারে। এই কলুষিত সমাজের জন্যই ভারতবর্ষ এখনো পিছনে। অন্য দেশের মিডিয়ার কথায় কান দেবেন না। সবাই পৃথিবীতে আমাদের রাষ্ট্রগুরুর বিরুদ্ধাচরণ করে, কিন্তু তারা জানে না এই রাষ্ট্রগুরুই হবেন পৃথিবীর ত্রাতা।”

অমল আস্তে আস্তে কান্না ভরা চোখে আরেকবার দেখল ওর ৪০০০ টাকা নোটের বান্ডিল ভরা ব্যাগটাকে। ব্যাগটাকে জড়িয়ে শুরু করল হাউ হাউ করে কান্না। ভালো রাজ্যের বুকে অনেকদিন পর কান্নার আওয়াজ শোনা গেল।

অলংকরণ - প্রমিত নন্দী