বৃষ্টি ভেজা বালিয়াড়ি

অর্পিতা সরকার


সেদিনও ঠিক এমনি এলোমেলো বাতাস বইছিল। আকাশ ছেয়েছিল মেঘের ঘনঘটায়। সঞ্চিতা একা দাঁড়িয়ে ছিল হোটেলের ব্যালকনিতে। ব্যালকনি থেকেই দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের অবিরত ঢেউয়ের আসা যাওয়া। পুরীর সি-বিচে সব সময় লোকের মেলা, তাই নির্জনতা খুঁজতে পুরীতে আসেনি সঞ্চিতা। ও এসেছে দূর থেকে মানুষের ভিড় দেখতে। মানুষের উপচে পড়া আনন্দকে দূর থেকে উপভোগ করে চলেছে ও।সাথে সমুদ্রের গর্জন ওকে কিছুতেই একলা হতে দেয় না। এই কারণেই বছরে একবার পুজোর ছুটিতে সঞ্চিতা চলে আসে পুরীতে।

ভিতরে ভিতরে যে মানুষ সম্পূর্ণ একা, তাকে নীরবতা আর টানে না। সঞ্চিতা প্রথম পুরী এসেছিল বাবা-মায়ের সাথে তখন ওর বয়েস তিন। তারপর কলেজ এক্সকারসনে। বাবা কিছুতেই ছাড়তে চায়নি ওকে। তবুও বন্ধুদের গোটা গ্রুপের করুণ আর্তির সামনে শেষ পর্যন্ত বাবার মত পেয়েই গিয়েছিল।

অর্ণবের সাথে একই কলেজে পড়লেও যেহেতু অর্ণব ওর থেকে দু বছরের সিনিয়র সেহেতু কলেজে সেভাবে পরিচয় হয়নি। পরিচয় হয়েছিল এই পুরীর সি-বিচে এসেই। তাও আবার বিশ্রী ঝগড়ার মাধ্যমে।

ওরা মেয়েরা মিলে একটা ঝিনুকের জিনিসের দোকানে ঢুকেছিলো। মেয়েরা হার, কানের দুল নিয়ে ভীষণ দরদাম চালাচ্ছিল। হঠাৎ একটা অরেঞ্জ ব্ল্যাক টিশার্ট পরা ছেলে বেশ গম্ভীর গলায় বলল, “এটা নিউ মার্কেটের দোকান নয়। এদের খুব বেশি লাভ থাকে না। এত দরাদরি করা উচিত নয়।”

গোটা দশেক মেয়ের দামাদামির চোটে দোকানদার যখন প্রায় রাজি ওদের কথা রাখতে, ঠিক সেই সময় অযাচিতভাবে জ্ঞানদাতা ছেলেটিকে দেখে বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে সঞ্চিতা বলেছিল, “এক্সট্রা কমিশনটা বুঝি আপনি খান?”

ছেলেটি বলেছিল, “আসলে একই কলেজে পড়ি কিনা,তাই তোমাদের আমাদের কলেজের স্টুডেন্ট ভাবতে একটু লজ্জা করছে আরকি!”

ব্যস, ফার্স্ট ইয়ারের সকলে মিলে ঝগড়া করতে শুরু করেছিল ওর সাথে। গোটা তিনেক ছেলে এসে বললো, “ছাড়ো অর্ণবদা... মেয়েদের সাথে কখনো ঝগড়া করতে যেও না। ওরা যুক্তি মানে না।”

এটা শুনেই মাথাটা আরও গরম হয়েছিল ইকোনমিক্স এর সঞ্চিতা দত্তর। তারপর তো হোটেলের একই লাঞ্চ টেবিলে খেতে বসে, সঞ্চিতা বলেছিল, “যুক্তিবাদীরা এত চিকেন চিকেন করছে কেন? তারা কি জানে না মুরগীর প্রাণ আছে?”

অর্ণব বলেছিল, “কি করবো ম্যাডাম। পাথর বালি খেয়ে তো থাকতে পারবো না। গাছ আর মুরগির মধ্যে পার্থক্য কোথায়?”

ঝগড়া শুরু হয়েছিল প্রথম দিনেই। তিনদিন ধরে চলছিল এই ঠোকাঠুকি।

সেদিন সকালে ওদের গ্রুপের সকলে যাচ্ছিল জগন্নাথ দেবের মন্দিরে পুজো দিতে। ওদের কলেজের মনীষা ম্যাডামের খুব ঈশ্বরে ভক্তি। পুরী এসে জগন্নাথ দর্শন করবে না তাই কখনো হয়!

ছেলেগুলো বেঁকে বসেছে। গোটা সকালটা মন্দিরে পাণ্ডাদের সাথে ঠেলাঠেলি করতে পারবে না বলে দিয়েছে। অগত্যা তিনজন ম্যামকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েদের গ্ৰুপটাই উঠলো গাড়িতে। গাড়িতে উঠেই সঞ্চিতা দেখলো ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আছে অর্ণব।

মনীষা ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বলছিল, “ম্যাম আমিও পুজো দিতে চাই... মা বলেছে পুজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে যেতে।”

সঞ্চিতা টিপ্পনি করে বলেছিল, “আহা! মায়ের বাধ্য ছেলে।”

খানিকক্ষণ পর থেকেই সঞ্চিতা খেয়াল করছিল, অর্ণবের হাতে না আছে ফুল না আছে পুজোর ডালা। কেবল মন্দিরের গেটের ফাঁক থেকে ছবি তুলে চলেছে। মনীষা ম্যাডাম বললেন, “অর্ণব তুমি আমাদের মেয়েদের কয়েকটা ভালো ছবি তুলে দাও তো।”

ব্যস, ক্লিকের পর ক্লিক...মনের আনন্দে ছবি তুলছিল অর্ণব।

“ম্যাডাম, দরজায় নক করছে কেউ...”

দরজা খুলতেই হোটেলের বয় জানতে এসেছে আজ ডিনারে কি নেবে সঞ্চিতা। একটু মনে করে ও বললো, “রুটি তরকা দিন।”

সেদিনও ওরা রুটি তরকা নিয়েই বসেছিলো, হোটেলের ডাইনিংয়ে। হঠাৎ ওই বিচ্ছু অর্ণব বলে বসলো, “ম্যাডাম আজ তো পুজো দিলেন মন্দিরে, আজ কি আমিষ খাওয়া ঠিক হবে?”

ব্যস, মনীষা ম্যাডাম বললেন, ঠিক বলেছ। ওরা যারা পুজো দিতে গিয়েছিল তাদের চোখের সামনে থেকে তরকা সরে গিয়ে নিরামিষ আলুর দম এসেছিল। সঞ্চিতা কটকট করে তাকিয়েছিল, আর অর্ণব হেসেছিল মুচকি মুচকি।

সমুদ্র স্নানের সময়েই বিপদটা হয়েছিল। জীবনে কোনোদিন সুইমিং পুলে না নামা সঞ্চিতা ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে চলে যাচ্ছিল। কিছুটা ঢেউয়ের বিপরীতে সাঁতরেই সঞ্চিতার হাত ধরেছিল অর্ণব। নোনতা জল খেয়ে, ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়ে সব ঝগড়া ভুলে অর্ণবকেই জড়িয়ে ধরেছিল সঞ্চিতা। অর্ণব কানের কাছে মুখ এনে বলেছিল, “স্যার-ম্যাডামরা দেখছে, এবার ছাড়ো।”

ইস! লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল সঞ্চিতার।

কে জানে কেন পুরীর বাকি দুদিন অর্ণবের সাথে আর কোনো ঝগড়া করেনি সঞ্চিতা। বরং অর্ণব রাগানোর চেষ্টা করলেও না রেগে হেসে ফেলেছিল।

অর্ণব বলেছিল, “ঝগড়াটাই বেশি এনজয় করছিলাম, জীবনদাতার কৃতজ্ঞতাটা বড্ড ভারী লাগছে যে।”

বন্ধুদের ভিড় এড়িয়ে এক দিকে এসে বসেছিলো সঞ্চিতা। আজ ও সমুদ্রের সাথে একলা থাকতে চায়। কিছু অচেনা গোপন অনুভূতি শেয়ার করতে চায়। ভিজে বালির মধ্যে আঙুল দিয়ে সঞ্চিতা আনমনে লিখেছিল , অর্ণবের নামটা... আবার বালি দিয়ে মুছে দিচ্ছিল... আবার লিখেছিল। হঠাৎ কানের কাছে এসে কেউ বললো, “আমার সারনেম চক্রবর্তী।”

ঘাড় ফেরাতেই পিছনে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব। সঞ্চিতা তখন একটা বড় হৃদয় চিহ্নের মধ্যে এঁকেছিল অর্ণবের নাম। তাড়াতাড়ি বালি দিয়ে মুছতে ব্যস্ত হলো। কথা না বলে, ওর পাশে বসে পড়লো অর্ণব।

তারপর বলল, “বলো তো...এই ঢেউ গুলো কি বলছে?”

সঞ্চিতা অবাক হয়ে বলেছিল, “ঢেউরা আবার কথা বলে নাকি?”

“নিশ্চয় বলে, প্রতিটা ঢেউ বালিয়াড়িকে কথা দিয়ে যাচ্ছে, এখুনি ফেরার। প্রত্যেকে কথা রাখছে দেখো। আবার এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে পাড়ের বালিকে।”

আকাশ সেদিনও ছিল মেঘলা। দু এক ফোঁটা পড়তেই অর্ণব বললো, “ওঠো ভিজে যাবে তো?”

সঞ্চিতা বলেছিল, “আমি তো ভিজতেই চাই।”

সি-বিচ প্রায় ফাঁকা হয়েছিল আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায়। একমাত্র বৃষ্টির প্রত্যাশায় বসেছিলো সঞ্চিতা আর অর্ণব।

কলকাতা ফিরেও পুরীর দিনগুলো কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না সঞ্চিতার। হয়তো অর্ণবেরও। তাই সঞ্চিতাদের ইকোনিমিক্স প্রফেসর লেকচার দিতে দিতে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলেছিলেন, “হে ইউ? আর ইউ ফার্স্ট ইয়ার ইকনোমিক্স স্টুডেন্ট?” গোটা ক্লাস ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিল, কোনাকুনি সঞ্চিতাকে দেখা যাচ্ছে এমন একটা বেঞ্চে বসে আছে আছে অর্ণব। ওর সামনে ফিজিক্সের বই খোলা।

প্রফেসর অপমান করছিল, অর্ণব তাকিয়েছিল সঞ্চিতার দিকে।

অর্ণব আর সঞ্চিতার নীরব ভালোবাসা বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওদের দুজনকেই। সঞ্চিতা আশা করেছিল, অর্ণব প্রপোজ করবে। একটা বছর পেরিয়ে গেলো, ক্যান্টিন... কলেজ ফেস্ট, বন্ধুদের জন্মদিনের পার্টি সবেতেই কথা হয়েছে, গল্প হয়েছে... হয়তো চোখের ভাষায় ছিল ভালোবাসার হাতছানি… তবুও বলা হয়ে ওঠেনি কিছুই।

বেশ কিছুদিন ধরেই খেয়াল করছে সঞ্চিতা অর্ণব যেন সব কিছু থেকে নিজেকে একটু একটু করে সরিয়ে নিচ্ছে। আইনক্সে সিনেমা দেখতে যাবো বললেই, বলছে বাড়িতে গেস্ট আসবে।
পার্ক স্ট্রিটে লাঞ্চ খেতে চলো বললেই বলছে মা কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

বেশ কিছুদিন ধরেই অর্ণব ওদের গোটা বন্ধু টিমকে এড়িয়ে চলছিল। ফাইনাল ইয়ার কমপ্লিট হওয়ায় অর্ণব কলেজ ছেড়েছে, ওর সাথে কথা বলার উপায় একমাত্র ফোন। সঞ্চিতাকে এড়িয়ে গেছে অর্ণব। তাই সংকোচে ফোনটাও করতে পারে না সঞ্চিতা। অর্ণবের কাছের বন্ধু বিপ্লবের কাছে গিয়েও বিশেষ উপকার হয়নি। সেও বলেছে একবছরে যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য ঘটে গেছে ছেলেটার। কেমন একটা আনমনা হয়ে থাকে, বিপ্লবের সাথেও নাকি ভালো করে কথা বলে না অর্ণব। আগে ওদের বাড়িতে যেত প্রায়ই এখন নাকি বিপ্লব যাবো বললেই অর্ণব নানা অজুহাতে ওকে যেতে বারণ করে।

এভাবেই পুরীর উত্তাল ঢেউ এসে মুছে দিচ্ছিল সঞ্চিতার হৃদয় থেকে ওর নামটা। সঞ্চিতা আপ্রাণ যুদ্ধ চালিয়ে বাঁচিয়ে রাখছিল অর্ণবের সাথে কাটানো সময়ের স্মৃতিগুলো।

তখন সঞ্চিতা মাস্টার্স করছে, একটা তীব্র গরমের দুপুরে অপেক্ষা করছিল ট্যাক্সী পাবার জন্য। অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়ে সঞ্চিতার গাড়ি ছাড়া যাতায়াতের অভ্যাস নেই। আজ বাড়ির গাড়ি গ্যারেজে বলেই ট্যাক্সীতে করে ইউনিভার্সিটি এসেছিল।

রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘামছিলো ও। হঠাৎই পিছন থেকে কেউ বলে উঠলো, “গাছের নিচে এসে দাঁড়াও। ট্যাক্সী এলে আমি ডেকে দিচ্ছি।”

খুব পরিচিত কণ্ঠস্বর... বহুদিন পরে ওই আওয়াজ শোনার ঘোর কাটিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলো সঞ্চিতা।

অর্ণব মৃদু হেসে বললো, “কেমন আছো?”

অভিমানে গলার স্বর বন্ধ হয়ে যেতে চাইছে সঞ্চিতার।

তবুও সামলে নিয়ে বললো, “চিনতে পেরেছো আমাকে?”

অর্ণব বললো, “যাকে ভোলার জন্য প্রতিমুহূর্তে লড়াই করতে হচ্ছে তাকে কি আবার নতুন করে চিনবো?”

সঞ্চিতার দুটো চোখের অবরুদ্ধ অভিমান যেন গাল বেয়ে নেমে আসতে চাইছে।

পুরীর ছবিগুলো পরে সব দেখিয়েছিল অর্ণব। প্রত্যেকটি ছবিতে শুধু সঞ্চিতা। দু একটাতে ওদের বান্ধবীদের আধ কাটা মুখ বা মাথা।

সঞ্চিতা বলেছিল, “এটা তুমি ঠিক করোনি। ওদের ছবি কেন তোলোনি?”

অর্ণব হেসে বলেছিল, “আমার ক্যামেরার লেন্সটা আমার থেকেও অবাধ্য কিছুতেই শোনেনি আমার কথা।”

আজও অর্ণবের ওয়ালেটে সঞ্চিতার হাসি মুখের ছবি রয়েছে। সঞ্চিতা বললো, “কোনো অধিকার নেই, আমার ছবি তোমার কাছে রাখার।”

অর্ণব বলেছিল, “সে নাহয় পার্স থেকে সরিয়ে দেওয়াই যায়। কিন্তু সমস্যাটা হলো, আমার মনের মধ্যে বারবার তুমি এসে ঘিরে ধরছ সঞ্চিতা।”

সঞ্চিতা বললো, “তাহলে আমাকে গ্রহণে বাধা কোথায়?”

ফুটপথের দিকে তাকিয়ে অর্ণব বলেছিল, “টাকার পাহাড়ে বসে স্বপ্নগুলোর দিকে তাকালে রঙিনই লাগে।

“কফি হাউসের আড্ডা, আইনক্সের মুভি, পার্কস্ট্রিটের রেস্তরাঁর খরচ করতে অক্ষম থাকলে তাকে বড্ড অসামাজিক মনে হয়।

“আমার বাবা নেই সঞ্চিতা খুব ছোট বেলায় মারা গিয়েছিলেন। মা আর আমি মামার বাড়িতেই ছিলাম। বড় মামার প্রশ্রয়ের ভাগ্নে হয়ে দিনটা ভালোই কাটছিল। বছর খানেক আগে সেই আশ্রয় টুকুও চলে গেছে সঞ্চিতা। মামা মারা গেলেন। এরপরেও কি মায়ের ওই টিউশনির সামান্য টাকায় বিলাসিতা করা সাজে?”

মধ্যবিত্তের স্বপ্নগুলো ঘুমের ঘোরেই রঙিন থাকে, চোখ মেলেই ধূসর হয়ে যায়।

“ট্যাক্সী…” ডেকে নীরব সঞ্চিতাকে তুলে দিয়ে গিয়েছিল অর্ণব।

সেদিন রাতেই সঞ্চিতা ফোনে বলেছিল, “আমি বাবা মায়ের সাথে কথা বলেছি, ওরা তোমাকে একবার আসতে বলছে । বাবা তোমার চাকরির ব্যবস্থাও করে দেবে বলেছে।”

অর্ণব বলেছিল, “সঞ্চিতা দূর থেকেও ভালোবাসা যায়... শুধু টাকার অংকে তাকে কিনতে চেও না। তোমার বাবার কাছে গিয়ে আমি ভিক্ষে চাইতে পারবো না।”

ওখানেই শেষ হয়েছিল অর্ণবের কথা। অভিমানের মেঘে ঢেকে গিয়ে আর কখনো কোনো যোগাযোগ করেনি সঞ্চিতা। শুধু দূর থেকে শুনেছিল, অর্ণব নাকি এম এস সির পর আর পড়েনি। কারোর সাথেই যোগাযোগ নেই ওর। মানসিক কষ্টগুলোকে সঙ্গী করেই এগোচ্ছিল সঞ্চিতার জীবন। অর্থের প্রাচুর্যে যে যন্ত্রনাগুলোর লাঘব হয়নি কখনো।

স্কুলের টিচারীটা পাওয়ার পরই বাবা মা বিয়ের যোগাযোগ করতে শুরু করে। সঞ্চিতা তখনও খুঁজে যাচ্ছিল অর্ণবকে। পুরোনো নম্বর বদলে ফেলেছিল ও। মামার বাড়িতে আর থাকতো না তখন। সমস্ত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল সঞ্চিতার।

অর্ণবকে বলা হলো না, উচ্চবিত্তদের স্বপ্নগুলোও কখনো কখনো ঝাপসা হয়ে যায়।

তারপর প্রতিটি পুজোর ছুটিতে সঞ্চিতার ঘোরার একটাই জায়গা পুরী। ওর চৌত্রিশ বছরের জীবনে পুরী যে কতবার এলো তা বোধহয় নিজেও ভুলে গেছে। প্রতিবার চেষ্টা করেছে ঢেউয়ের কথা শোনার। একবারও ঢেউ ওর কথা শোনেনি।

নিজের মনেই হাসছে সঞ্চিতা। অর্ণবের গোয়েন্দাপনা মনে করে। একবার কলেজ ক্যান্টিনে সঞ্চিতা হিমাদ্রির সাথে বসে গল্প করছিল। সঞ্চিতা দেখতে পায়নি। হিমাদ্রি বলেছিল, “সঞ্চিতা... তোকে থার্ড ইয়ারের একটা ছেলে নজর বন্দি করে রেখেছে। যখনই তুই আর আমি কোথাও যাই আমি খেয়াল করেছি ওই ছেলেটা তোকে খেয়াল রাখে।”

হিমাদ্রি ছিল সঞ্চিতার খুব ভালো বন্ধু। হিমাদ্রির দৃষ্টি অনুসরণ করতেই দুটো পরিচিত চোখ গাছের আড়ালে সরে গিয়েছিল। হেসে ফেলেছিল সঞ্চিতা। অর্ণবের ওই নজরদারি সেদিন ভীষণ ভালো লেগেছিল।
হোটেল থেকে নেমে ধীর পায়ে এগুলো সমুদ্রের দিকে। বাবা মায়ের অবাধ্য মেয়ের খেতাবটা সঞ্চিতা জিতেছিল যেদিন বিয়ে করবে না বলে বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিল।

মানুষের মুখের ওই অফুরান হাসি দেখতে দেখতে কেমন হারিয়ে যাচ্ছিল সঞ্চিতা। ভীষণ ইচ্ছে করছিল আবার সমুদ্রতীরে ভিজতে। শুধু ভেজার সঙ্গী আজ আর কেউ নেই। আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে সিবিচ। বৃষ্টির পূর্বাভাস দিচ্ছে মেঘলা, তারা ঢেকে যাওয়া আকাশ। স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে আছে সঞ্চিতা। এক ফোঁটা পড়লো ওর গালে। না আজ আর কেউ বললো না, এই চলো ভিজলে শরীর খারাপ করবে যে! তবুও যেন এই বৃষ্টির সাথে সেই তেরো বছর আগের বৃষ্টির বড্ড মিল। সেদিন অর্ণব হাত ধরে টেনেছিলো সঞ্চিতার। ওর হাতের পুরুষালী আকর্ষণে কেঁপে উঠছিল সঞ্চিতার শরীর।

সামুদ্রিক হাওয়ায় আর বৃষ্টির ফোঁটার বেগে বেশ শীত করছিল ওর।

“সিবিচ ফাঁকা... একা থাকাটা ঠিক নয়...” পরিচিত গলার অনুরণন। এমন বহুবার হয়েছে সঞ্চিতার। বারবার ভুল প্রমাণিত হয়েছে ও। না চারিদিকে খুঁজেও তখন পায়নি অর্ণবকে। আজও হয়তো...

“কি হলো, ভিজে যাচ্ছ যে...”

ভয়ে ঘাড় ঘোরাতে চাইছে না সঞ্চিতা। আরেকটু শুনতে চাইছে ওর স্বপ্নের, আকাঙ্ক্ষার গলাটা। হয়তো পিছন ফিরলেই মরীচিকা দূরীভূত হবে।

আলতো স্পর্শ টের পেল নিজের হাতে। অর্ণব ধরে আছে ওর হাতটা। সেই কলেজ বয়ের মুখটা পরিবর্তিত। একটা গোঁফ রয়েছে ঠোঁটের ওপরেই। চোখে একটা সরু ফ্রেমের চশমা। আজ রেড টিশার্ট নয়.. স্কাই ব্লু শার্ট পরে আছে অর্ণব।

সঞ্চিতার চোখ দুটোও কি বেইমানি করছে ওর মনের সাথে!

অর্ণব বললো, “চলো...”

ঘোর লাগা গলায় সঞ্চিতা বললো, “তুমি এখানে?”

“এই পুজোর ছুটিতে পুরী এসেছি। অবশ্য শুধু ছুটি কাটাতে এসেছি তাই নয়, একটা কাজও আছে। এর আগেও বার দুয়েক এসেছিলাম।”

সঞ্চিতা খুব সাবধানে বললো, “হাতটা ছাড়ো। তোমার স্ত্রী এসেছেন সঙ্গে?”

ঘাড় নেড়ে অর্ণব বললো, “হ্যাঁ… তোমার হাত ধরে থাকলে তোমার হাজবেন্ড বুঝি দেখে ফেলবে?”

সঞ্চিতা মাথা নেড়ে বললো, “হ্যাঁ দেখে ফেলবে।”

পাশাপাশি হাঁটছে ওরা। এত বছর পরও নিশ্চুপ।

নিস্তব্ধতা ভেঙে সঞ্চিতা বললো, “এখন কি করো? অনুভূতি বিক্রি করে বেড়াও, নাকি অন্য কিছু?”

আহত স্বরে অর্ণব বললো, “ফটোগ্রাফির ব্যবসা করছি। বিভিন্ন সেমিনারে ছবি তুলি। নিজেরও স্টুডিও করেছি। পুরীতে একটা বড় কোম্পানির সেমিনার অ্যারেঞ্জ করেছে... তাই ওদের সাথেই...”

সঞ্চিতা হেসে বললো, “তা তোমার লেন্স আর অবাধ্য নেই তো এখন? সে অন্য অনেকের ছবি তুলতে রাজি হয়েছে তো?”

কথার সুর ঘুরিয়ে অর্ণব বলেছিল, “তোমার হাজবেন্ড নিশ্চয় খুব বড় চাকরি করে?”

“না, ব্যবসাদার।”

বালি ভেঙে ওরা এগিয়ে গেলো নিজেদের হোটেলের দিকে।

হোটেলের বিছানায় সারারাত নির্ঘুম কাটালো সঞ্চিতা। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল অর্ণবের মুখটা। কত বদলে গেছে বিয়ের পর। একবারও বললো না, চলো সঞ্চিতা তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। শুধু হোটেলের নামটা জেনেই দূর থেকে বললো, তোমার হোটেল এসে গেছে সঞ্চিতা।

আসলে ওর স্ত্রী হয়তো অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

ভোর বেলা ঘুম ভেঙেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো সঞ্চিতা...

গেটের বাইরের দিকে তাকাতেই দেখলো অর্ণব এই হোটেলের একটা বয়ের সাথে হাত পা নেড়ে কিছু বলছে! চোখাচোখি হতেই পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো ও।

সঞ্চিতা ঘন্টাখানেক পরে হোটেলের বাচ্চা ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “সকালের ভদ্রলোক কি জিজ্ঞেস করছিল?”

ছেলেটি বললো, “ম্যাডাম ওনার ফোনে আপনার ছবি রয়েছে দেখলাম। জিজ্ঞেস করছিল, আপনার সাথে কে এসেছে? আপনার স্বামী কেমন মানুষ?”

সঞ্চিতার ঠোঁটের কোণে হাসি।

ছেলেটি মাথা নেড়ে বললো, আমি বললাম, “উনি তো প্রতিবার আসেন। আমাদের হোটেলেই ওঠেন।স্বামী তো আসেনা।”

অর্ণবের গোয়েন্দা ভাবটা এখনো আছে দেখে ভালো লাগছিলো। ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসেছে আজ সঞ্চিতাকে। অর্ণব কাল বলেছিল, ওরা ক্যামেলিয়া হোটেলে উঠেছে। সঞ্চিতা সালোয়ারটা পরে, পায়ে পায়ে এগোয় ক্যামেলিয়ার দিকে।

হোটেলের রিসেপশনে খোঁজ করছিল, অর্ণব চক্রবর্তী কোন রুমে রয়েছে। ওনার সাথে আর কে কে এসেছে।

ঠিক সেই সময় অর্ণব বললো, “কাকে খুঁজতে এসেছো… মিসেস চক্রবর্তীকে?”

চমকে উঠে সঞ্চিতা দেখলো অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে ওর ঠিক পাশেই।

রিসেপশনিস্ট বলছে, “ম্যাডাম, উনি তো একাই এসেছেন... খাতার এন্ট্রি তো তাই বলছে…”

সঞ্চিতা ছিটকে বেরিয়ে এসেছে হোটেল থেকে। অর্ণব হাঁটছে পিছন পিছন। ঠিক যেমন কলেজে সঞ্চিতা রাগ করলে অর্ণব পিছু নিতো ওর রাগ ভাঙানোর জন্য তেমনি।অনেক বছরের অভিমান জমে আছে । এত সহজে তা গলবে বলে মনে হচ্ছে না।

অর্ণবের পায়ের গতি দ্রুত হয়েছে। সঞ্চিতা হাঁপাচ্ছে...

ওদের পায়ের সব চিহ্ন আঁকা হচ্ছে নোনতা ভিজে বালিয়াড়িতে। ঢেউ বলছে আমি কথা রেখেছি ফিরিয়ে দিয়েছি তোমাদের ভালোবাসা।


অলংকরণ - লেভজেন চেপিল (আলামি)