বোবা উত্তর - রুমেলা দাস

সবে মার্চ। কলকাতার রোদে পা রাখলে, শুধু শরীর কেন? মনও জ্বলে দাউদাউ করে। তা ভালোমতোই টের পাচ্ছেন, সায়ন মল্লিক। জ্বালা ধরা চোখে সামনের মানুষজন, ফুটপাথে বসা হকার, জেব্রা ক্রসিংয়ের খানিক দূরে দাঁড়ানো খৈনি টেপা পুলিশ সবই বড্ড অচেনা লাগছে। অথচ এ রাস্তায় যাতায়াত, সেই সাদা-কালোর সময় থেকে।

জীবনদীপ বাসস্ট্যান্ড থেকে চ্যাটার্জী তলার কাছাকাছি পৌঁছতে সময় লাগে মিনিট পনেরো কুড়ি। তবু মনে হচ্ছে এ পথ অনন্ত। বারেবারে গুলিয়ে যাচ্ছে কোন পথে যাবে সায়ন? মিলেমিশে তাল পাকিয়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো সন্দেহ, বিষ, অপবাদ যা কয়েকমাস যাবদ সহস্র ফণার বিষ ঢেলেছে সায়ন আর প্রমিতার জীবনে। তিল তিল করে বেড়ে ওঠা একুশ বছরের একটা স্বাধীনচেতা জীবনের স্বাধীনতা শক্ত সুতোর গেরো পরিয়েছে সায়নের ফুসফুস দুটোকে।

প্রেম! এই শব্দটা শুধু বিষাক্ত ফলার আকারে বিসর্গ চিহ্নের মতো জেগে রয়েছে জীবনে। শোভন সমাজে যার কোনো জায়গা নেই। অনিশ্চয়তাকে কোনোভাবেই মেয়ের জীবনে মেনে নিতে পারবেননা তিনি। হাজার কৌতূহলে হয়তো ঢেলে দিতে পারবেন জল। কলেজ ফেরত রিমিতার জীবনে চরম অশোভন গোয়েন্দাগিরি করতে চলেছেন আজ। কোনোদিন ভাবতে পারেননি এই দিনটা দেখতে হবে এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী হয়ে।

পার্কের সামনে যখন পৌঁছলেন তখন ঘড়িতে সাড়ে চারটের কিছু বেশি। পকেটে বেজে উঠলো আইফোন। তেতো মনে সবুজ বোতাম টিপতেই প্রমিতার উদ্বেগ ভরা কণ্ঠস্বর—“কি গো? রিমি কে দেখেছো?”

এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই সায়নের। আগামী প্রতিটা ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড কি হতে চলেছে! তা সম্পূর্ণ অজানা। শুধু সন্দেহকে আশ্রয় করে রয়েছে কতগুলো প্রশ্নচিহ্ন।

“না।” ছোট্ট উত্তরে জীবনের সমস্ত শঙ্কাকে গলা টিপে ফোন বন্ধ করে সামনের দিকে তাকাতেই চোখ চলে গেল ডানদিকের বাঁধানো চাতালের দিকে। কৃষ্ণচূড়ার ছায়া মাখা সবুজে খানিক দূরে দূরে স্কুল কলেজ ফেরত অপরিণত। আর তারই মাঝে কমলা কামিজে, ঘামে ভেজা চুলে দাঁড়িয়ে রিমি। সায়নের একমাত্র মেয়ে। কার অপেক্ষায়? কার জন্য এত উদ্বিগ্নতা ওর চোখেমুখে? এ অস্থিরতা শুধু রিমির নয়, সায়নেরও। বুকের মধ্যে হাজার হাতুড়ি একসাথে পিটছে।

পাঁচ, দশ, পনেরো মিনিট....অপেক্ষার ঘড়ি ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার মুহূর্তেই এক ছাপোষা, সাদামাটা বছর চব্বিশের যুবক এসে দাঁড়ায় রিমির সামনে। পঞ্চাশের পৌঢ়ত্ব দেখে এক অদ্ভুত সত্যি। সেই বিশ্বাস, সেই ভরসার চাউনি।

আবছা হয়ে যাওয়া বাইশ বছর আগের একক্ষণ ভেসে উঠছে চোখের সামনে। আবছাগুলো বুক পেতে দাঁড়াচ্ছে বর্তমানের।যা কেবল সোনার গুঁড়ো হয়ে উড়ে বেরিয়েছে স্মৃতির ঘর জুড়ে। সমাজের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করতে পারেনি যে ছাপোষা যুবক। বেছে নিয়েছিল অভিভাবকের মতামত। ঘর পেতেছিল বাধ্য ছেলের মতো। আজ আবার সেই ঘুমিয়ে থাকা হাজার খরগোশ বুক জুড়ে তোলপাড় এনেছে নতুন করে। বিকালের রোদ থেমে থাকা একটা অধ্যায়ে আলো ফেলছে আবারও।

গোধূলি আলোয় এক স্বপ্ন দেখতে দেখতে সায়ন মল্লিক পা বাড়ায় নিজের সেই ঘরে। যেখানে পূর্ণতা পাবে সেই আগামী, যেখানে শুধুই ভরসা আর ভালোবাসার মেলবন্ধন। এ যেন এক অন্য বসন্ত।

অলংকরণ - কর্ণিকা বিশ্বাস