বাইরে পারদের কাঁটা চল্লিশের গন্ডি টপকে গিয়েছে। ঘরের মধ্যেকার শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রটি তার কাজ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছিল।
“আমার ঘরটা এর চেয়ে ঠাণ্ডা।” গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে বললেন ৪-সির বাসিন্দা পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই মিসেস নীলিমা সেন। তিনি এসেছেন একুশ তলায়, মিসেস রায়চৌধুরীর ফ্ল্যাটে। মিসেস গার্গী রায়চৌধুরীও নয় নয় করে পঞ্চাশের কোঠা পেরিয়েছেন বেশ কিছুদিন।
মিসেস রায়চৌধুরী বললেন, “ছোটখাট ব্যাপারগুলোই হজম হয় না, বুঝলে! গরমটা তাও মেনে নিতে পারি। কিন্তু জল পড়ার এই টপটপ শব্দটা! এ তো আর সহ্য হচ্ছে না হে। ওই যে, শুনতে পাচ্ছ না?”
“না”, মিসেস সেন জবাব দিলেন, “তবে তুমি কি বলতে চাইছ বুঝতে পারছি। এই তো, আমার ছেলে সুপ্রিয়, সেদিন তার ব্লেজারের হাতার বোতামখানা খুইয়ে এসছে। হাজার বিশেকের ব্লেজারটা, বোতাম ছাড়া পুরো কানা হয়ে গেল যে। পেতলের অমন সুন্দর কারুকাজ করা বোতাম! কোথায় যে ফেলে এল?”
“আরে তাতে সমস্যার কি আছে? অন্য হাতার বোতামটাও খুলে নাও না!”
“চলবে না গো, একদম চলবে না। ব্লেজারের সেই বিউটিটাই আর থাকবে না। আরে বাবা বোতাম নড়বড় করছে, তো অপেক্ষা না করে তক্ষুনি সেলাই করে নাও না বাপু! আমি বুঝি না এত্ত সোজা জিনিস একটা পঁচিশ বছরের ছেলের মাথায় ঢোকে না কেন। হুটহাট যখন খুশি বেরিয়ে যায়, আমাকে বলেও যায় না কখন ফিরবে—”
মিসেস রায়চৌধুরী অধৈর্যের সঙ্গে বলে উঠলেন, “ওই—ওই শোন! তুমি শুনতে পাচ্ছ না? বাথরুমে গেলেই জল পড়ার শব্দটা পরিষ্কার শুনতে পাবে।”
মিসেস সেন কান খাড়া করে অত্যন্ত নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে শোনার চেষ্টা করলেন। চারদিক শান্ত। তার মধ্যে শোনা গেল, টপ—টপ—টপ—টপ—
মিসেস রায়চৌধুরী বললেন, “কি জ্বালাতন রে বাবা। সারা রাত্তির ধরে এই চলছে। তিন দিন হয়ে গেল।”
মিসেস সেন তাঁর সোনালি ফ্রেমের বড়সড় চশমাটা ঠিক করলেন, ভাবখানা এমন যেন এবারে ভালো করে শুনতে পাবেন। ঘাড় কাত করে খানিক শোনার চেষ্টা করে বললেন, “বোধহয় শাওয়ার থেকে জল পড়ছে। উপরতলার ২২-জিতে। মিসেস গাঙ্গুলির ফ্ল্যাট। আমি ওকে চিনি। মেয়েটা খুবই ভালো। আমি বলি কি তুমি ওকে গিয়ে একবার এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বল। ও কিচ্ছুটি মনে করবে না।”
মিসেস রায়চৌধুরী গম্ভীরভাবে বললেন, “আমি খামোকা ওকে ভয় পেতে যাব কেন? আমি এরই মধ্যে পাঁচবার ওর দরজায় নক করেছি। কেউ সাড়া দেয়নি। ফোনও করেছি। কেউ সাড়া দেয়নি।”
“তাহলে ও ঘুরতে গেছে।” বললেন মিসেস সেন, “গরমকালে তো সবাই ঘুরতে যায়।”
“ও যদি পুরো গরমকাল বাড়িতে না থাকে, তাহলে কি পুরো গরমকাল আমায় জল পড়ার শব্দ শুনতে হবে?”
“কেয়ারটেকারকে বল না!”
“সে আর এক গর্দভ। ওর কাছে মিসেস গাঙ্গুলির ‘ইস্পেশাল’ তালার চাবি নেই। তার ওপর এমন সাহস, মুখের ওপর সাফ বলে দিল কিনা সামান্য জল পড়ছে বলে দরজা টরজা ভাঙতে পারবে না! কী দিন কাল পড়েছে বল দিকি। যাই হোক ও মনে হয় কোথাও ঘুরতে যায়নি। ওর গাড়ি তো নিচে দেখলাম।”
মিসেস সেন খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, “অন্য কারো গাড়িতে গেছে হয়তো।”
মিসেস রায়চৌধুরী নাক সিঁটকালেন, “অন্য কারো গাড়িতে? মিসেস—”
মিসেস সেন ভ্রূ কুচকালেন, “ও ডিভোর্সি— তো কি হয়েছে? ওর বয়স তো বেশি না— ত্রিশ কি পঁয়ত্রিশ। আর ও একটু বেশী সাজগোজ করতে পছন্দ করে। এতে তো আমি খারাপ কিছু দেখছি না।”
“তাই বুঝি?” গলায় শ্লেষ মিশিয়ে বললেন মিসেস রায়চৌধুরী, “ও যে কী করে সারাটা দিন সেটা আমার ভাল মতনই জানা আছে। আমি তো সবই শুনতে পাই।”
“কী শুনতে পাও?”
“পায়ের আওয়াজ। আরও নানান শব্দ। ওর ঘরটা আমার ঠিক ওপরে কিনা। আর আমি ওর বেডরুমটা কোথায় জানি। বুঝলে?”
মিসেস সেন বিরক্তির সুরে বললেন, “সেকেলে লোকদের মত কথা বলো না তো! ও কী করছে না করছে সেটা ওর ব্যাপার।”
“বেশ তো! যা খুশি তাই করুক না! কিন্তু ও বাথরুমটা এতো বার ব্যবহার করে, তাহলে কলটা একটু টাইট দিয়ে বন্ধ করতে পারে না? ডাকলে দরজায় সাড়া দিতে পারে না? আমার তো মনে ওর ঘরে সব দামি দামি জিনিস আছে তাই কাউকে ঢুকতে দেয় না।”
“ভুল জানো। একদম ভুল। ওর ঘরে একেবারে সাদামাটা কিছু ফার্নিচার আর গাদাগুচ্ছের টবের গাছ আছে, ব্যস।”
“তুমি কী করে জানলে, অ্যাঁ?”
মিসেস সেন আমতা আমতা করে বললেন, “না–মানে— ও বাড়িতে না থাকলে আমি ওর গাছে জল দি। একলা মানুষ কিনা। তাই ও ঘুরতে টুরতে গেলে আমি একটু হেল্প করে দি।”
“তাই? তাহলে ও বেড়াতে গেলে তো তুমি নিশ্চয়ই জানবে। তা সেরকম কিছু বলেছে নাকি?”
“না তো।”
মিসেস রায়চৌধুরী বিজ্ঞের মত বললেন, “তাহলে নিঘ্ঘাত শরীর খারাপ বলে সাড়া দিতে পারছে না!”
“দরজায় আসতে পারবে না হয়তো, কিন্তু ওর মোবাইলটা তো সব সময় ওর সঙ্গেই থাকে।”
“হয়তো ওর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। শোন তো, আমার মনে হয় ও মরে গেছে আর তাই জলের কল বন্ধ করতে ভুলে গেছে।”
“জলজ্যান্ত বাচ্ছা মেয়ে। ওর আবার হার্ট অ্যাটাক কী?”
“আজকালকার দিনে কিছুই বলা যায় না। যেভাবে জীবন কাটায়— হয়তো ওর বয়ফ্রেন্ড ওকে খুন করেছে। আমাদের ও ঘরে ঢুকতেই হবে!”
“এভাবে চোর ডাকাতের মত বিনা অনুমতিতে ঢোকা—”
“আরে বাবা, চাবি আছে তো! ও বাড়ি না থাকলে ওর গাছগুলোকে তো তুমি মরতে দিতে পারো না। তুমি গাছে জল দেবে আর আমি জলের কলটা বন্ধ করে দেব। ক্ষতিটা কোথায় এতে? আর ও যদি মরে গিয়ে থাকে, তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না ওর লাশটা বেমালুম পড়ে থাকুক?”
“ও মরেনি রে বাবা!” মুখে এ কথা বললেও মিসেস সেন নিচে গিয়ে চাবিখানা নিয়ে এলেন।
“এই ফ্লোরে তো কেউ থাকে না দেখছি,” ফিসফিস করে বললেন মিসেস রায়চৌধুরী, “যে কেউ যখন তখন দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়তে পারে।”
“শ্ শ্ “, মিসেস সেন ফিসফিসিয়ে বললেন, “যদি ও ঘরের ভেতরে থাকে আর বলে বসে, ‘কে ওখানে?'”
“তখন তুমি বলবে তুমি জল দিতে এসেছ আর আমি জলের কল বন্ধ করতে অনুরোধ জানাব।”
চাবি ঘোরাতেই মসৃণভাবে তালা খুলে গেল। মিসেস সেন লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে দরজাটা একটু ফাঁক করে একটা টোকা দিলেন।
“কেউ সাড়া দিচ্ছে না”, অধৈর্যের সঙ্গে চাপা গলায় বললেন মিসেস রায়চৌধুরী। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন।
“এসিটাও চলছে না। কেউ নেই, বুঝলে? তুমি গাছে জল দাও দিকি।”
দরজা বন্ধ করে মিসেস সেন বললেন, “এখানটা ভীষণ গুমোট লাগছে। পুরো ওভেনে ঢুকলাম মনে হচ্ছে যেন।”
ওঁরা করিডর দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছিলেন। ডানদিকে ফাঁকা রান্নাঘর, ফাঁকা বাথরুম—
মিসেস রায়চৌধুরী বাথরুমে উঁকি মারলেন। “এখানে তো জল পড়ছে না। মাস্টার বেডরুমের লাগোয়া বাথরুমটা দেখতে হবে।”
করিডরের শেষে বাঁদিকে বেডরুম। গাছগুলো ভিতরের ব্যালকানিতে।
“তুমি জল দাও গে।” বললেন মিসেস রায়চৌধুরী, “আমি বাথরুমে—”
তিনি দরজা খুললেন। তারপর কোনো শব্দ না করে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মুখ হাঁ হয়ে গেছে।
মিসেস সেন তাঁর পাশে এলেন। গন্ধে টেঁকা দায়। “কী—”
“হে ভগবান।” বললেন মিসেস রায়চৌধুরী। কিন্তু চিৎকার করার মত দমও আর অবশিষ্ট নেই।
ঘরের সব জিনিসপত্র চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। বিছানার অবস্থা তথৈবচ। মিসেস গাঙ্গুলির মাথাটা বিছানার ধার থেকে ঝুলছে, তাঁর লম্বা কালো চুল মেঝে অব্দি ঝুলে পড়েছে, গলায় স্পষ্ট আঙ্গুলের ছাপ, একটা হাত মেঝের ওপর দুলছে। হাতে কি যেন একটা জিনিস চক চক করছে।
“পুলিশ!” বললেন মিসেস রায়চৌধুরী, “এখুনি পুলিশে খবর দিতে হবে।”
মিসেস সেন হতচকিতের মত এগিয়ে গেলেন।
“কিছু টাচ করো না যেন”, বললেন মিসেস রায়চৌধুরী।
হাতে কি যেন একটা জিনিস চক চক—
মিসেস সেন তাঁর ছেলের বোতামখানা খুঁজে পেয়েছেন।
মূল - দ্য লিটল থিংস/আইজ্যাক আসিমভঅলংকরণ - কর্ণিকা বিশ্বাস