হাঙর - মিলন গাঙ্গুলী

“দ্বীপে হাঙর পাওয়া যায় না?” জানতে চাইলাম।

ঢক ঢক করে বিয়ার গিলছিল টাকো । খালি বিয়ারের টিনটা দূরে ফেলে নতুন আরেকটা টিন তুলে নিতে নিতে বিরক্ত হয়ে বলল, “
দ্বীপে হাঙর আসবে কি করে? ওরা সাগরে থাকে। অগভীর জলেও চলে আসে কখনও কখনও। জোয়ারের জল চলে গেলেই লেগুনের ভেতরে আটকা পড়ে যায়। তখন যে সাঁতার কাটতে নামে তার কপালে খারাবি হয়। তবে বেশির ভাগ সময় হাঙরটা মারা যায়।

“তুমি হাঙর নিয়ে অনেক কিছু জানো তাই না?” হাসলাম।
পালাউ দ্বীপ
“উহু, ভাল জানে পালাউ (palau) দ্বীপের লোকজন।”

“পালাউ দ্বীপ এখান থেকে কত দূর?”

“খুব বেশি দূর না। দ্যাখ না কত হালি হালি পালাওয়ান এই দ্বীপে আসে কাজ করার জন্য। অদের ওখানে বেতন কম। ঘণ্টায় মাত্র দেড় ডলার। তাই।”

“বেশ বড় দ্বীপ?”

“বড়। তবে মাত্র একটা দ্বীপ নিয়ে পালাউ না। ২৫০টা দ্বীপ মিলে মিশে পালাউ। দেখতে বেশ সুন্দর। ছায়া ছায়া স্বপ্নের মত। গেলে আর আসতে ইচ্ছা করবে না।”

 “তুমি চলে এলে যে?”

“বারে মারিয়ানা আইল্যান্ডে আমার স্মৃতি বেশি। মানুষ তো স্মৃতির কাছেই ফিরে আসে। নিয়ম। এই নিয়ে একটা হাইকু আছে —
মেঘ উড়ে বেড়ায় আকাশে।
জলাভূমির স্মৃতি
ওকে বৃষ্টি বানিয়ে ফেলে।”

“বাহ নিশ্চয় তোমার লেখা?”

“ঐ আর কি।”
 দাঁত বিহীন মাড়ি বের করে হাসল টাকো। বিয়ার নেবে না তুমি?

এই দ্বীপে বিয়ার না খাওয়া একটা অপরাধের মত। কোন অনুষ্ঠানে গেলে বা কারও বাড়িতে গেলেই হাতে একটা বিয়ারের টিন ধরিয়ে দেবে প্রথমে। জানতেও চাইবে না খাও কিনা । এক আদিবাসিকে এও বলতে শুনেছি — ঈশ্বর খুব কৃপণ তাই বৃষ্টির সময় বিয়ারের বদলে পানি ফেলে। কাউকে যদি বলি বিয়ার খাই না তবে এমন ভাবে তাকায় যেন আট দশটা খুন করে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিংবা শিশু ধর্ষণের আসামি আমি।

আইস বক্স ভর্তি করে বিয়ার এনেছে টাকো। জাপানি বুড়ো তাই আইস বক্স ভর্তি কিরিন ইচিবান বিয়ার। 
প্রথমে এক ডলারের বরফ কিনে অর্ধেক বরফ আইস বক্সে রেখেছে। পরে এক কেস মানে চব্বিশটা বিয়ার রেখে বাকি বরফ দিয়ে বিয়ারের টিনগুলো কবর দিয়ে রেখেছে।আইস বক্সের ভেতরে টানা দুই দিন ঠাণ্ডা থাকবে বিয়ারগুলো।

টাকো জাপানি। কিরিন ইচিবান ছাড়া অন্য কোন বিয়ার খায় না। আমেরিকান কোম্পানির বিয়ার মরে গেলেও ছোঁবে না। কাজেই আইস বক্স কিরিন ইচিবান বিয়ারে ঠাসা। আইস হাউজ বিয়ারটা আমার ভাল লাগে। তবে খুব কম চলে ওটা। অনেক দোকানে রাখে না। রেডডগ নামে একটা বিয়ার বেশ ঢাক ঢোল বাজিয়ে নেমেছিল ব্যবসায়। তিন মাস পর গুটিয়ে চলে গেছে। অথচ স্বাদটা ভাল ছিল।


সামনে পাথরের টেবিল। পিচ্চি সিরামিকের বাউলে মূলার কিমচি। বুড়ো আঙুলের সমান আস্ত মুলা ভিনেগার, লবণ আর বাটা মরিচের ভেতরে চুবিয়ে রাখা হয় দীর্ঘ দিন। কোরিয়ানদের খুব প্রিয়। বিয়ারের সাথে যায়। সিরামিকের আরেকটা তশতরিতে এক মুঠো কাচকি মাছ। কাঁচা না । বেসনে ডুবিয়ে ভাঁজা। টাকোর কাছে কয়েকটা বিঘৎ খানেক লম্বা সোরড ফিস আছে। 
সাশিমি করা হবে। অর্থাৎ বেশ মৌজে আছি আমরা।

সাশিমি আসলে কাঁচা মাছ জাপানি কায়দায় খাওয়া। শুনতে বিরক্তকর মনে হলেও খুব একটা খারাপ না কিন্তু। মানে আমি যখন খেয়েছি খারাপ লাগেনি। টুনা মাছের সাশিমি প্রথম খাওয়া। লেগুনের বাইরে প্রচুর টুনা ধরা পড়ে। ওদের একটা প্রজাতির ডানাগুলো হলুদ রঙের। ইয়েলো ফিন টুনা বলে। পাতলা করে কেটে নিয়ে সয়াসস, ভিনেগার আর লেবুর রসে সামান্য লবণ নিয়ে ভিজিয়ে খেতে অপূর্ব লাগে।

ইয়েলো ফিন টুনা সাশিমি
জাপানি বাবুর্চিরা টুনা মাছের ফালি করার জন্য প্রায় ব্লেডের মত ধারলো পিচ্চি এক ধরের চাকু ব্যবহার করে। সাশিমি নাইফ বলে।
টাকোর কাছে যে তিনটে সোরড ফিস আছে মাত্র বিঘৎ খানেক লম্বা। বাচ্চা মাছ। কপাল দোষে ধরা পড়েছে। দেখতে কাইক্কা মাছের মত লাগছে। ছুরি দিয়ে মাছ কাটা একটা শিল্প। কেউ স্বীকার করুক বা না করুক। আমি জানি। দ্বীপের ছেলে বুড়ো সবাই দারুণ পারে কাজটা। সবার কাছেই চাকু থাকে। হয় জঙ্গল নাইফ বা জ্যাক নাইফ। জিনিসটা বৈধ। আঠারো বছর হলে যে কেউ চাকু বহন করতে পারে। কোমরে ঝুলায় সবাই। চামড়ার খাপে ঘুমিয়ে থাকে। চাকু ছাড়া কম ছেলে পিলে দেখেছি। 

সহজ ভাবেই মাছের ফালি করে ফেলল টাকো। মাথা ছুড়ে ফেলে দিল সমুদ্রে। 
অন্য মাছেরা খাবে।

জঙ্গলের কাছেই বেঁটে এক ধরনের লেবু গাছ হয়। অমন লেবু গাছ কোথাও আগে বা পরে দেখিনি। গোল মার্বেলের সাইজের লেবু। ঝুপসি মত বাঁটুল গাছে পাতার চেয়ে লেবু ধরে বেশি। চাকু বসানোর আগেই ফিনকি দিয়ে রস বের হয়। আদিবাসীরা কালামানসি বলে লেবুটাকে। ইংরেজি নাম জানি না। খোঁজ নিয়েছি। কেউ বলতে পারেনি।
কালামানসি
এক ডজন কালামানসি হাফ করে ফালি করা হল। বোতলের ঢেউ খেলানো একটা ছিপি ফালি করা লেবুর মাঝে রেখে কায়দা করে রস বের করা হল। সিরামিকের বাউলে রেখে কালামানসির রস আর লবণ মেশানো হল। সামান্য সয়া সস হলে ভাল হত। নেই। মাছের পাতলা ফালিগুলো ভিজিয়ে রাখা হল। টাকো বলল জঙ্গলে গিয়ে খুঁজে দেখতে। কড়ে আঙুলের নখের সমান বুনো মরিচ হয়। পিশাচের মত ঝাল। সাশিমির সাথে দিলে ভাল জমবে।

কিন্তু জমানোর মুড নেই আমার। হাফ ডজন বিয়ার পেটে ঢুকে গেছে। হাফ মাতাল হয়ে আছি। জঙ্গলে গেলে যে কোন গাছের তলায় চিত হয়ে পড়ে থাকবো। দিনের বেলা বিয়ার খাওয়া খারাপ।
অ্যালকোহল সহজেই মিশে যায় রক্তে। ভাল মত তাকাতে পারছি না। সূর্য মনে হচ্ছে দুটো উঠছে। চারিদিকটা রাংতার মত জ্বল জ্বল করছে।

কে না জানে খাবারের আসল স্বাদ পরিবেশের উপর নির্ভর করে। একই খাবার ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন হয়। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আলু পোড়া খেয়ে অবাক হয়েছি। অপূর্ব স্বাদ। মাছের সাশিমি কি পাঠানটুলির মোড়ে বসে খেতে পারব? না ভাল লাগবে? কিন্তু এখানে পরিবেশই অন্যরকম।

সামনে প্রশান্ত মহাসাগর। লেগুনের ভেতরে নীল টলটলে পানি । লেগুনের বাইরে ফিরোজা রঙের। তারও পরে সমুদের রঙ সীসের মত। সাদা রঙের এক ঝাঁক সামুদ্রিক পাখী উড়ছে মাছের লোভে। সৈকত যেন চিনির দানার । হরেক সাইজের প্রবাল । স্তূপ হয়ে আছে সাগরের শ্যাওলা।

বাতাসে নোনা ঘ্রাণ।

আমরা দুই বন্ধু। এক বাঙ্গালী ছোকরা। আরেক জন জাপানী বুড়ো। যার বয়সের কোন গাছ পাথর নেই। রোববার, ছুটি। পান করছি মনের আনন্দে। তো এই সময় কাঁচা মাছ খেতে খারাপ লাগবে কেন?
তো সব ধরনের খাবার আসলে চেখে দেখা দরকার। যদি সেটা আপনার রুচি আর ধর্ম বিশ্বাসের সাথে বিরোধ না ঘটায়। আদিবাসীদের প্রচলিত সব খাবার খেয়েছি। খারাপ লাগেনি। একটা জিনিস চেষ্টা করেও খেতে পারিনি। সেটা হল বালুত (Balut)। ফিলিপিনোদের খাবার। এবং দুনিয়ার সবচেয়ে বিচ্ছিরি খাবার।
জিনিসটা আর কিছুই না। সেদ্দ হাঁস বা মুরগীর ডিম। ডিমটা ১৪ বা ২১ দিন তা দেয়ার পর ভেতরে বাচ্চাটা যখন বেশ পরিণত হয়ে যায় তখনই সেদ্দ করে খায়। ভিয়েতনাম আর থাইল্যান্ডেও নাকি খায়। এক আদিবাসী বন্ধু আমাকে বালুত খেতে দিয়েছিল। না জেনে এক কামড় দিয়েছিলাম। বন্ধুর সাথে তিন মাস কথা বলিনি। 
ছি! সম্ভব হলে ওকে খুন করতাম। পরিকল্পনা আর সুযোগেরর অভাবে পারিনি। মোটিভ যথেষ্ট শক্ত ছিল।
বালুত
আদিবাসীদের খাবারে কোন বৈচিত্র্য নেই।বারবিকিউ ছাড়া কিছু যায় না ওদের মুখে। রুটিফল, মিষ্টি আলু, চুপড়ি আলু আর সমুদ্রের মাছ খেয়ে দিব্যি দানবের মত সাইজ হয়ে গেছে ওদের।

বিয়ারে টিনে চুমুক দিয়ে মুখ খুলল টাকো —
 হাঙরের ভয়াল ব্যাপার হচ্ছে এর দাঁত। রেতির মত খাঁজকাটা আর ধারালো। দাঁত পরে গেলে আবার নতুন দাঁত উঠে। সারা জীবন। হিসাবে এক হাঙরের ৩০ হাজার দাঁত উঠে সারা জীবন। হাঙরের আরেকটা মজার বৈশিষ্ট্য হল বরফ শীতল পানিতে থাকলেও ওর দুই চোখ জমে যায় না। ওদের চোখেই অমন অঙ্গ আছে যাতে চোখ জমে যাবার হাত থেকে রক্ষা করবে। হাঙরের ভয়াল যে জিনিস সেটা হল মায়ের পেটে থাকার সময় বড় হাঙরটা ওর ভাই বোনকে খেতে শুরু করে। কি ভয়ংকর!

হাঙরের আক্রমণের অনেক ঘটনা জানি। বেশ বিখ্যাত কিছু ঘটনা আছে। অনেক লেখকই অমন ঘটনা সংগ্রহ করে বেশ পেল্লাই সাইজের বই লিখেছেন। বইগুলো ভাল চলে। পাঠকের কাছে নাকি রোমাঞ্চ উপন্যাসের মত লাগে বইগুলো।

H. David Baldridge নামে এক ভদ্রলোকের লেখা সার্ক অ্যাটাক বইটা বেশ। রেফারেন্স সহ যে ঘটনা অনেকের মুখে শুনেছি বা বইতে পড়েছি সেটা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ঘটনা।ফিলিপাইন সাগরে গোয়াম দ্বীপের কাছাকাছি সাগরের উপকূলে চারদিন ধরে ৯০০ সৈনিক আটকা পড়েছিল। তখনই হাঙরের ঝাঁক এসে আক্রমণ করে। টানা খেতেই থাকে সৈনিকদের। হাঙরের ননস্টপ খাওয়ার এই স্টাইলকে বলে — ফিডিং ফ্রেঞ্জি। শেষ পর্যন্ত ৩১৬ জন সৈনিক বেঁচে ছিল।

আর বিজ্ঞানীরা বলেন হাঙর নতুন কোন প্রাণী না। সমুদ্রে ওরা ছিল কোটি কোটি বছর আগে থেকেই। ডাইনোসরের বহু আগে হাঙর দুনিয়ায় এসেছে।আনুমানিক ৪০০ মিলিয়ন বছর আগে। ডাইনোসর মারা গেছে কিন্তু ডাইনোসরের আগের এই হাঙর টিকে গেছে। 

“মজার ব্যাপার কি জানো? হাঙর কিন্তু গভীর সমুদ্রে আক্রমণ করে না সৈকতের কাছাকাছি অগভীর সাগরে আক্রমণের ঘটনাগুলো বেশি হয়।”

“ক্ষয়ক্ষতি কেমন হয়? মানে মানুষ মারা যায় কেমন?' মানুষ মারা গেলে খুব খারাপ লাগে অমন একটা মুখের ভাব ধরে প্রশ্ন করলাম।

“দেখ মেলন হাঙরের আক্রমণে মানুষ মারা যায় এটা খুব রেয়ার ঘটনা। হাজার হাজার মানুষ সাগরে নামছে প্রতিদিন। আক্রমণের ঘটনা বছরে কয়টা শুনতে পাবে? খুব কম। গড়ে ৩০ থেকে ৫০টা কাহিনি শুনবে সারা দুনিয়ায় । তার মধ্যে ৫ থেকে ১০টা ঘটনা মারাত্মক। হাঙর মানুষখেকো এটা আজও 
প্রমাণ হয়নি। কিন্তু হাঙরের ফিনের জন্য প্রতি বছর ২০ লক্ষ হাঙর মারে শিকারিরা। স্যুপ বানায়। এক বাউল স্যুপের জন্য কত বড় অপচয়। ফিন ছাড়া আর কিছু কাজে লাগে না হাঙরের শরীরের। হাঙর ধরা পড়া মাত্র পিটিয়ে মেরে ফিন কেটে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়।”

“হাঙর নাকি হরেক প্রজাতির?”

“৫০০ ধরনের হাঙরের নাম জানে বিজ্ঞানীরা। আরও হাঙর আছে। নাম দেয়া হয়নি । নতুন নতুন ধরা পরে প্রতি বছর। একটা মজার কথা শুনেছিলাম। প্রতিবছর হাঙরের হাতে যত মানুষ মারা যায়, এশিয়াতে তার চেয়ে বেশি মানুষ নারকেল গাছ থেকে ঝুনা নারকেল পরে মাথা মুথা ফাটিয়ে মারা যায়।”

ব্যাপারটা সিরিয়াস হলেও হেসে ফেললাম। ঐ এক দোষ আমার। সিরিয়াস কথাতেও হাসি। তাছাড়া টাকোর বাচন ভঙ্গিটাই অমন।
তবে আমিও শুনেছি কুকুরের কামড়েও এর চেয়ে বেশি মানুষ মরে। যত না হাঙরের কামড়ে মরে। 

“খাবারের টান পড়লে নাকি সৈকতের কাছাকাছি চলে আসে ওরা?”

“তা তো বটেই।”
 টাকো বিরক্ত। ওভার ফিশিঙের ফল।
হোয়েল সার্ক
“ওভার ফিশি?”

হ্যাঁ। তুমি বেকুব নাকি? আগে আমরা এত মাছ ধরতাম? মোটেই না। দ্বীপের একজন জেলে মাছ ধরতে গিয়ে বড় একটা মারলিন বা মাহি মাহি (Mahi Mahi) ধরতে পারলে খুশিতে লগবগ করতে করতে বাড়ি ফিরে আসতো। নিজে খেত। পাড়া পড়শিদের বিলিয়ে দিত। তিন দিন আর নৌকার নোঙর তুলত না। পরে কি হল?

কি হল? প্রশ্ন করলাম। আসলেও জানি না তো।

কটমট করে আমার দিকে তাকাল জাপানী বুড়ো। যেন সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। 
ব্যাঙের ছাতার মত এক গাদা হোটেল গজিয়ে উঠল দ্বীপে। আনাচে কানাচে। মারিয়ানা আইল্যান্ড হচ্ছে চিরবসন্তের দ্বীপ। সারা বছর। টুরিস্ট আসে ঝাঁক বেঁধে। জাপানের ধনী ব্যবসায়ীরা গোপনে তাদের কিশোরী সেক্রেটারি নিয়ে দুইদিনের জন্য বিজনেস ট্যুরে চলে আসে।এই হোটেলওয়ালারা দ্বীপের জেলেদের চাপ দিতে লাগল বেশি করে মাছ ধরে দেয়ার জন্য। হোটেলওয়ালারা বিজ্ঞাপন দিত — তাদের হোটেলে স্থানীয় মাছ শুধু বিক্রি করে। একদম টাটকা। হেন তেন।

তো, জেলেরা কোমর বেঁধে মাছ ধরতে নামলো। সমানে ধরতে লাগল মাছ। আইনে ব্যবহার করা নিষেধ অমন জালও ব্যবহার শুরু করলো। কেউ রেহাই পেল না। বাচ্চা মাছ বুড়ো মাছ সব ধরা পড়লো। চলে গেল সবাই টুরিস্টদের সিরামিকের তশতরিতে। ইকোসিস্টেম বলে একটা কথা আছে জানো তুমি?”

এতক্ষণে মাথা নাড়লাম। জানি।

“তো সেটাই নষ্ট হয়ে গেল। খাবারে টান পড়লে মানুষ চুরি ডাকাতি করে। অন্যের খাবারে হাত বাড়ায়। রিফের বাইরে পেট ভর্তি খিদে নিয়ে হাঙর চলে আসে সৈকতের কাছে। তখন হাঙর বনাম মানুষের ক্যাচাল লাগে।”

“এই দ্বীপে কাউকে কামড় দিয়েছিল হাঙরে?”

“হয়েছে। কম। গত বছর আঙ্কেল জো-কে কামড় দিয়েছিল।”

“এটা আবার কোন জো? এই দ্বীপে একটা পাথর তুলে ছুড়ে মারলে যেকোন এক জন জো অথবা জেমসের শরীরে লাগবে।”

“তা বটে।”
 একমত হল টাকো। এই দ্বীপে জো, জোসেপ, জশুইয়া, জন এই নামগুলো হালি হালি। আমি যে জো-এর নাম বলছি সে হচ্ছে মোটা জো। ফ্যাট জো।

“আদিবাসী সবাই তো মোটা। তরমুজের সাইজ।”

“তা বটে।”
 হতাশভাবে মাথা নাড়ল টাকো। আঙ্কেল জো খুব বিখ্যাত। ফিশারম্যান ক্লাবগুলোতে গেলেই পাবে। আড্ডাবাজ মানুষ। রোজ সিক্স প্যাক (মানে এক বসায় ছয় বিয়ার) খায়।

“এত টাকা পায় কই?”
 অবাক না হয়ে পারলাম না।

“সরকারী ভাতা। ফুড স্ট্যাম্প। দ্বীপের সবাই পায়। সেই জন্য তো কাজ করে না। সারাদিন আড্ডা দেয় আর বিয়ার খায়।”

আফসোস হল। ইস কেন বাঙ্গালী হয়ে জন্ম নিলাম। এই দ্বীপে আদিবাসী হয়ে জন্ম নিলে কত সুখের জীবন পেতাম। এই যে এই মুহূর্তে বেকার আছি। কাজ নেই। মা বাবাকে টাকা পাঠাতে পারছি না। ভয়ে চিঠিও লিখি না।

“হাঙরের আক্রমণের সবচেয়ে পুরানো ঘটনা কোনটা?”

“সঠিক জানা নেই। তবে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস দাবি করেন যীশুর জন্মের ৫০০ বছর আগে এক ঝাঁক হাঙর পার্সিয়ান নৌ বহরের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। হাঙর নিয়ে কথা বলে শেষ করা যাবে না। সমুদ্র নিজেই এক মহাকাব্য। হাঙর এই মহাকাব্যের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। হাঙরকে নিয়ে বহু রোমাঞ্চকর উপন্যাস লেখা হয়েছে। তবে সফল বই হচ্ছে  — জস। পিটার বেঞ্ছলি-এর লেখা। সত্য ঘটনা নিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা হয়েছিল ক্লাসিক এই ক্রিয়েচার হান্টিং থ্রিলারটা । সিনেমা তৈরি হয়েছে। সেটাও সফল।”
সমুদ্রের সব প্রাণীই আমাকে কৌতূহলী করে তোলে। হাঙরের প্রতি আলাদা আগ্রহ আছে। তবে টাকোর প্রিয় বিষয় হচ্ছে সমুদ্রের স্রোত। সমুদ্রের অতলে ঘুরে বেড়ায় গরম আর বরফ শীতল পানির স্রোত। এরাই নাকি নিয়ন্ত্রন করে সারা দুনিয়ার আবহাওয়া!

কত বছর বাঁচে ওরা? মানে এই হাঙরেরা। গড়ে এদের আয়ু ২৫ বছর। তবে টিভির একটা ডকুমেন্টারিতে দেখেছি বিচ্ছিন্ন ঘটনা আছে হাঙর ১০০ বছরও বাঁচে। ভরা জ্যোৎস্নার রাতে সমুদ্রে জোয়ার উপচে পড়ে। নোনা পানি এসে ঢুকে পড়ে খাঁড়িতে। লেগুন ভর্তি হয়ে যায়। উপকূলের কাছে চলে আসে হাঙর। খিদেটাও যেন বেড়ে যায়। চাঁদের ক্ষয় আর বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে নাকি হাঙরের খাদ্যাভাস বদলে যায়। ভরা জ্যোৎস্নার  রাতে সমুদ্র নিরাপদ না মোটেও। এরা যা পায় তাতেই কামড় বসায়। টাইগার সার্কের পেটের ভেতরে গাড়ির টায়ার,লাইসেন্স প্লেট এমনকি গ্যাসোলিন ট্যাংকও পাওয়া গেছে।

“সব চেয়ে বড় হাঙর কোনটা?”

“হোয়েল সার্ক।”

“আর সবচেয়ে পিচ্চি?”

“পিগমি সার্ক। মাত্র ৮ ইঞ্চি।”
পিগমি সার্ক
সৈকতের কাছে অগভীর পানিতে ওদের দেখেছি বেশ কয়েকবার। মনে হয় বড় আকারের ট্যাংরা মাছ। এরা পিচ্চি হলেও শিকার ধরতে সাগরের এক মাইল গভীরেও নাকি ডুব দিতে পারে। ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস।

ওরা খেতেই থাকে খেতেই থাকে। খাওয়া পেলেই খায়। গ্রেট হোয়াইট হাঙর ১১ টন খাবার খায় বছরে। আমি হাঙরের পাখনার স্যুপ খাইনি কখনও। তেমন আগ্রহ পাইনি। চাইনিজদের কাছে জনপ্রিয়। বিশেষ কোন স্পেশাল উৎসবে ওরা হাঙরের পাখনার স্যুপ খায়। বিবাহবার্ষিকী বা অমন কোন কিছুতে। হাঙরের পাখনা শুকিয়ে নিলে দেখতে লম্বা নুডলসের মতই লাগে। লম্বা নুডলস পরিবেশন করা চাইনিজদের মতে ভাল। জীবন লম্বা হবে। দেখ দেখি কাণ্ড!

মাছ ধরার বা শিকার করার লাইসেন্স পাওয়া খুব সহজ। তানাপাগ গ্রামে সরকারী অফিস আছে। গিয়ে দেড় পাতার একটা ফর্ম পুরন করে ১০ ডলার দিলেই এক বছরের জন্য বিন্দাস সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধর। কোন সমস্যা নেই। শুধু কোকনাট ক্র্যাব ধরতে হলে ৭৫ ডলার দিতে হবে। আর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর এই তিন মাস মাত্র ধরতে পারবে।

“একটা মিথ আছে হাঙরকে নিয়ে। হাঙর নাকি দুপুর বেলা কাউকে আক্রমণ করে না। সত্যি নাকি?”

“তোমার মাথা।”
 দ্রুত মাথা ঝাঁকাল টাকো। দুপুরবেলা সৈকত খালি থাকে। লোকজন উঠে যায় সাঁতার থেকে। লাঞ্চ করে। কাজেই সৈকতে তত বেশি লোকজন থাকে না। আক্রমণের ঘটনা কম হয়। হাঙর আমাদের মত তিন বেলা খায় না। খিদে পেলেই খায় না। খাবার পেলেই খায়।

সূর্য ডুবে যাবার আগ পর্যন্ত পানাহার করলাম আমরা। আরও থাকতাম। বিয়ার শেষ। মাছ ভাজাও শেষ। বাড়ি যেতে হবে। দুইজনের কারও কাছেই গাড়ি নেই। টাকো হাঁটা ধরবে। মাঝরাস্তায় কেউ ওকে পেলে তুলে নেবে। লিফট দেবে সানরকি গ্রাম পযন্ত। অথবা হেঁটেই যাবে গ্রারাপান পযন্ত। সেখান থেকে পাবলিক বাসে চড়ে সানরকি গ্রাম। বন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে আমিও বাড়ির পথ ধরলাম।

সান আন্টোনিও থাকি। দ্বীপের গোড়ার দিকে গ্রামটা। আমার স্বপ্নের জায়গা। সান এন্টোনির পর কবলার ভিল নামে একটা নিঝুম গ্রাম। তারপর শেষ।
বীচে লেখক
কিলিলি বীচে আমরা আসর বসিয়েছিলাম। সেখান থেকে সান আন্টোনিও গ্রাম মাইল দেড় দূর। মাতাল অবস্থায় এত পথ হেঁটে যাওয়া এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। টানা লম্বা একটা পথ চলে গেছে সৈকতের ধার দিয়ে। সৌখিন মানুষজন দৌড়ায় এই পথে।

হেঁটে চললাম।

দুই পাশে নারকেল গাছের দঙ্গল। সাগর থেকে নোনা বাতাস ভেসে আসছে সাই সাই করে। পাশের বড় কালো পিচের পথ দিয়ে হুউস করে চলে যাচ্ছে গাড়ি। 

হাঁটছি।

কত হাজার হাজার মাইল দূরের এক দ্বীপের পাথরের ব্লক বিছানো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছি।

মাতাল।

দুই পাশে বুনো ঘাসে ছাওয়া । ঘাসের পাতাগুলো ব্লেডের মত ধার। ডান দিকে থৈ থৈ সমুদ্র। বামে দোকান, ক্যাফে, নাইট ক্লাব আর পোকার রুম।

রাত মাত্র নেমেছে।

আকাশের রঙ ঘন কালচে নীল। রুটি ফল গাছের উপর ডানা ঝাঁপটে উড়ে যাচ্ছে বাদুর। পার হলাম সুগার কিং ডক। টাউন হাউজ মার্কেট। চালান কানুয়ার পোস্ট অপিস। রাস্তার পাশে পিচ্চি পিচ্চি টঙের দোকান। ঝলসানো মুরগী আর শুয়োরের মাংস বিক্রি করে। এক ডলার। লোভনীয় ঘ্রাণ।

সান আন্টোনিও পৌঁছলাম সাড়ে আঁটটার সময়। নিঝুম একটা গ্রাম। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে একটা কাঠের দোতলা বাসা। বিশাল এক কড়ই গাছের নীচে। সাথে ছয়টা পিচ্চি কোয়াটার টাইপের বাসা। একটায় আমি থাকি। আসলে আমরা।

প্রতিটা 
ব্যারাকের নাম আছে। যা ভিন্ন রকম অর্থ বহন করে। যেমন ২৬ ব্যারাক। এই ব্যারাকে ২৬ জন বাঙ্গালী থাকে। বেশি না। কমও না। একজন চলে যাবার আগের রাতে নতুন একজন হাজির হয়।

আরেক ব্যারাকের নাম কুষ্টিয়া ব্যারাক। সঙ্গত কারণেই এই ব্যারাকে একগাদা কুষ্টিয়ার ছেলে থাকে। যারা সারাক্ষণ — ও রে লালন মরল জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা হেন তেন টাইপের গান বাজায়।

আমাদের ব্যারাকের নাম গেলমান ব্যারাক। গেলমান নামে এক লোক এই ব্যারাক ভাড়া নিয়েছে তাই। লোকটা ঝাড়ুর শলার মত রোগা। বিরক্তিকর চরিত্র। আমরা গেলমানকে কেউ পছন্দ করি না। তাতে মোটেও লজ্জিত না। গেলমানও কষ্ট পায় না। লোকটা পরনিন্দুক, ঈর্ষাকাতর, মদ্যপ, তাসেং পার্টি (তাস খেলা পছন্দ করে যে), নিয়মিত নাইট ক্লাবে যায় এবং চাইনিজ মেয়েদের প্রতি দুর্বল। তারপরও আমরা টিকে আছি। এটা ফ্রি আইল্যান্ড। যার যা খুশি করতে পারে। বাধা দেয়ার কে?

আমাকে দেখে হাসল গেলমান। “
কি ভাগ্নে চাকরির কোন খবর?
হতাশ ভাবে মাথা নাড়লাম।

দুই মাস হয়ে গেল। কাজ নেই। পাবো সে সম্ভাবনাও নেই।

পকেটের জমানো টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সামনে বিপদ।

এতদিন পরও ঘুম ভাঙ্গার পর হঠাৎ বুঝি না কোথায় আছি। বেশির ভাগ সময় ঘুম ভাঙ্গে গরমে। সৈকতের কাছে বাসা হওয়ায় বুঝা যায় গরম কত প্রকার ও কি কি। 
মারিয়ানা আইল্যান্ডে লেখক 
বিশাল দুই কড়ই গাছের তলায় বাসা। তাও কিছু হয় না। আগে পাহাড়ের উপর ছিলাম। সান্তালরিস গ্রামে। বিকেলের পর সুন্দর হাওয়া বইত। মাঝরাতে হালকা শীত করত। এখন তো মনে হয় সারাক্ষণ আভেনের ভেতরে আছি। মেঘলা দিনগুলোতে সমুদ্র থেকে ভিজে বাতাস ভেসে আসে, সেই দিনগুলো ভাল লাগে অবশ্য।
ঘুম ভা
ঙ্গতেই দেখি গনগনে দুপুর। গত এক মাস নিয়ম করে দুপুর বেলা সমুদ্রে গিয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করি। প্রায় ঘণ্টা খানে পর উঠে আসি উপরে। নোনা পানিতে ভিজে গায়ের রঙ কালো হয়ে গেছে। বাসায় এসে ভাল করে আরও একবার শাওয়ার নিতে হয় লবণ পরিষ্কার করার জন্য।

চিনির মত বালিতে হেঁটে সাগরের কাছে চলে গেলাম। সাগর শান্ত। লেগুনের ভেতরে পরিষ্কার নীল পানি । বালতি বালতি নীল রঙ ঢেলে দিয়েছে যেন কেউ। শ্যাওলা সৈকতের উপর উঠে গেছে ঢেউয়ের তালে। রোদের তাপে কেমন একটা গন্ধ ছড়াচ্ছে।

হাতে করে একটা মাস্ক নিয়ে এসেছি। চোখে দিলে পানির তলায় সব পরিষ্কার দেখা যায়। চোখে জ্বালা ধরে না।

সৈকতে গিয়ে বোকা হয়ে গেলাম। পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে একটা। গাড়ির পিছনটা পিক আপ ভ্যানের মত। সৈকতের নরম বালির উপর সুন্দরভাবে চলে এই গাড়িগুলো। পাশে দৈত্যের সমান দুইজন অফিসার। একজন বেশ মোটা। আরেকজন আরও মোটা।দুই আঙুলের চুটকি মেরে এক অফিসার ডাকল আমাকে। বুক চিতিয়ে সামনে গেলাম।

“বস তুমি মেক্সিকান নাকি?”
 রসালাপের ভঙ্গিতে বলল মোটা অফিসার।

“নাহ, বস। বাঙ্গালী। বাংলাদেশ।”
 জবাব দিলাম।

“বাংলাদেশ দ্বীপ অনেক দূরে নাকি? পালাউ দ্বীপের চেয়ে দূরে?”

“না বস। ওটা দ্বীপ না। দেশ। এশিয়াতে।”

“নাম কি তোমার?”

“মিলন।”

“মেলন। ভাল কথা তোমাকে অবৈধ ভাবে মাছ ধরার ফাঁদ পাতার জন্য গ্রেফতার করলাম আমরা।”
 হাসি হাসি ভাবে বলল মোটা অফিসার।

“আমার চৌদ্দ গুষ্টির কেউ মাছ ধরা জানি না।” সত্য কথাই বললাম।

“উহু কথা সত্য না।”
 মুচকি হাসে বলল দ্বিতীয় অফিসার। মানে আরও মোটা অফিসার। চাষ বাস করা আর মাছ ধরা এশিয়ানরাই শুরু করেছিল দুনিয়াতে। তো তুমি বলতে চাও লেগুনের ভেতরে মাছের ফাঁদগুলো তুমি ফেলনি?

“মাছের ফাঁদ দেখতে কেমন তাই জানি না।”

“জিনিসটা যে অবৈধ সেটা জান?”

“সেটাও জানি না।”

“চালানকানুয়া আর সান আন্টোনিও সৈকতের লেগুনে সবচেয়ে বেশি চোরাই ফাঁদ পাই আমরা। কারণ এই দুই জায়গায় এশিয়ান বেশি থাকে।”

“পুলিশের কাজ লেগুন থেকে মাছের ফাঁদ আবিষ্কার করা নাকি?”
 অবাক হলাম। 
“আমরা মারিয়ানা ভিজিটর বুর‍্যোর লোক।” পকেট থেকে আইডি বের করে দেখলো আরও মোটা অফিসার। “লেগুন থেকে ফাঁদ তুলছি আমরা।

চেয়ে দেখি আসলেও দুই তিন জন লোক লেগুনের ভেতরে জাইঙ্গা পড়ে ডুবাডুবি করছে।

“পেয়েছেন কিছু?”

“নিশ্চয়ই। দেখতে চাও?”
 হাসল সে।

গাড়ির পেছনে হাত বাড়িয়ে দিল প্রথম অফিসার। তুলে আনল লোহার একটা খাঁচা। খরগোশ ধরার ফাঁদের মত। আমি তাই ভেবেছি। অথবা বেজি ধরার ফাঁদের মত।

“সহজ জিনিস।”
 ব্যাখ্যা করলো অফিসার। যে কেউ বানাতে পারবে। মাছ সহজেই ঢুকে যাবে। বের হতে পারবে না। লেগুনের ভেতরে বা বাইরে ফেলে রাখ। সময় মত দড়ি টেনে তুলে নাও। ভেতরে মাছ ভর্তি। বাসায় নিয়ে গরম তেলে ভেজে খাও। সাথে বিয়ার। কি মজা? জিনিসটা অবৈধ এই জন্য যে দড়ি ছিঁড়ে একবার হারিয়ে গেলে এটা একটা চিরস্থায়ী মরণফাঁদ হয়ে যায় মাছের জন্য। ভেতরে মাছ ঢুকে মরতে থাকে। মরতেই থাকে। এমন অনেক ফাঁদ পেয়েছি আমি, ভেতরে মরা মাছের কাঁটায় ভর্তি। পচে গিয়ে গন্ধ ছড়ায়। সেই গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে আরও মাছ গিয়ে ঢুকে ফাঁদের ভেতরে।

খারাপ লাগলো।

“আমরা দ্বীপের আদিবাসিরা এই ফাঁদ বানাতে পারি না। ফিলিপিনোরা করে এই কাজ। লোহার খাঁচা না থাকলে পানির বোতল কেটেও বানায়। এই জন্য সময় পেলেই টহল দেই সৈকতে। জোয়ারের সময় ফাঁদ পেতে যায় ওরা। ভাঁটার সময় এসে তুলে নেয়। কাজটা করে রাতের বেলা। তেমন সন্দেহজনক কাউকে দেখলে ৯১১ নাম্বারে ফোন দেবে । ঠিক আছে?”

মাথা নাড়লাম।

“স্যার একটা মরা হাঙর পেয়েছি
 যেই দুই তিন জন লোক সাগরে ডুবাডুবি করছিল তাদের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে বলল।

“নিয়ে এসো।”
 হুকুম দিল আরও মোটা অফিসার।
মাছের ফাঁদে হাঙর 
সমুদ্র থেকে চেঙদোলা করে লম্বা কোল বালিশের মত কি যেন নিয়ে এলো তিনজনে মিলে। বাদামী রঙের একটা মাছ। ছেঁড়া একটা জালে প্যাঁচানো। ধপাস করে মাছটা ফেলল আমাদের পায়ের কাছে। চিনতে পারলাম — স্যানডবার সার্ক। ছবি দেখেছি। বাস্তবে প্রথম দেখলাম। খুব ছোটবেলায় ঢাকার জাদুঘরে কাচের বয়ামের ভেতরে বাচ্চা হাঙর দেখেছি। তারপর এই আরেকবার। মরে আছে ওটা। 
জোয়ারের সময় লেগুনের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। ওখানেই ছেঁড়া জাল ফেলে রেখেছিল অসতর্ক কোন মাছশিকারি। বা ছেঁড়া জালটাও জোয়ারের টানে এসেছিল। কে জানে। মরার আগ তক লড়াই করেছে বাদামী এই হাঙরটা। সারা শরীরে প্রবালের আঁচড়। মুখটা বিমর্ষ করে মরে আছে এখন। মায়া লাগছে।

কয়েকটা ছবি তুলল দুই অফিসার। মরা হাঙরের রিপোর্ট লিখল। দলের একজন পিকআপের পিছন থেকে বেলচা তুলে নরম বালি খুঁড়ে গর্ত করে কবর দিল বাদামী মাছটাকে।

“বেচারা।”
 দুঃখী গলায় বলল এক অফিসার।

চুপচাপ দেখছিলাম ওদের কাণ্ড।

“কবর দিলেন যে।”
 প্রশ্ন করলাম।

“কি করব?”
 দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল প্রথম অফিসার। মরা হাঙর খাও তুমি? লেগুনের ভেতরে এসে মারা গেছে ওটা। বাইরে মারা গেলে আমাদের কোন দায়িত্ব ছিল না। শেষ একটা সম্মান ওর প্রাপ্য।

“সম্মান না দিয়ে লেগুনের বাইরে ফেলে দিতেন। অন্য সামুদ্রিক প্রাণীরা ওর মরা দেহ খেত। ইকোসিস্টেম বজায় থাকতো।”

কট মট করে আমার দিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ওরা। তারপর সদ্য তোলা ফাঁদগুলো নিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল। হাঙরের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম । একা।

দূরে কয়েকটা সামুদ্রিক পাখি অলস সুরে ডাকছে।


ছবির সৌজন্য - লেখক