যাত্রা, সুন্দরবন আর আজকের একজন মানুষ - সুমন বিশ্বাস

[এটি কোন পুস্তক বিষয়ক আলোচনা নয়, স্মৃতিকথা নয়, ভ্রমণ কাহিনী নয়। ঠিক যে কি তা আমি নিজেই পরিষ্কার করে বলতে পারব না। ওই একটু আধটু অভিজ্ঞতার বর্ণনা আর নিজের চিন্তাভাবনাকে কলমের ডগায় আনার চেষ্টা। বেশ বড় হয়ে গেল লেখাটা, জানি না ক’জন ধৈর্য বজায় রেখে শেষ অব্ধি পড়তে পারবেন। কয়েকটি ছবিও দিয়েছি লেখাটিতে উল্লেখ করা বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে।]

সম্প্রতি একটি বই হাতে পেলাম। ‘চিৎপুর চরিত্র’, ষাটের দশকে যাত্রাবন্ধু হিসাবে জনপ্রিয় প্রবোধবন্ধু অধিকারীর লেখা।
পড়তে যে খুব ভাল লেগেছে তা বলব না, প্রচুর নিজের পিঠ চাপড়ানি আর একঘেয়ে কূটকচালিতে ভর্তি। এই লেখকের হাত দিয়ে অসামান্য উপন্যাস ‘ধলেশ্বরী’ কি করে বেরিয়েছিল ভাবতেই অবাক লাগছে। তাছাড়া ঘটনাগুলো প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরনো, আজকের দিনে সেই সব ঘটনা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে মূল্যহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু পড়তে গিয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছি, অন্ধকারের আড়ালে থাকা একটা অচেনা জগতের উপর তারার আলো পড়ে কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা আবছা একটা ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। পরিষ্কার করে দেখার চেষ্টা করছি চশমার কাঁচ মুছে, কিন্তু অন্ধকার কাটছে না।

ইটি পড়তে গিয়ে নাম পেলাম অনেকের, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের উল্লেখ করি। জানতে পারলাম প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা অহীন্দ্র চৌধুরী বিখ্যাত হয়েছিলেন যাত্রাতে অভিনয়ের সূত্রেই, কিন্তু পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছেন যখন, তখন আর মানতে চান নি বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে যাত্রার গুরুত্ব।
অহীন্দ্র চৌধুরী
রয়েছেন যাত্রালক্ষ্মী বীণা দাশগুপ্তা, যিনি কয়েক বছর আগে পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন। আছে প্রখ্যাত মানুষদের চরিত্রে অভিনয় করে বিখ্যাত হওয়া শান্তিগোপালের উল্লেখ, যাঁর সাথে একবার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কথা বলেছিলাম।

জানতাম না মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় যাত্রাপালার জন্যে সুর দিতেন। এও জানতাম না প্রখ্যাত জাদুকর পি সি সরকারের ভাই জাদুকর এ সি সরকারের যাত্রাপালাতে জাদুর পশরা নিয়ে হাজির হওয়ার কথা হয়েছিল।

এমন আরো বহু বিখ্যাত পরিচিত-অপরিচিত নামের সাথে একটি নামের উল্লেখ বারবার চোখে পড়ল- ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ, জানতে পারলাম তাঁর বাস ছিল হাওড়ার সেই অঞ্চলে যেখানে আমরা রয়েছি গত চল্লিশ বছর ধরে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম ইনি পঞ্চাশের দশকের বিখ্যাত অভিনেতা, যাত্রা জগতে বিখ্যাত ছিলেন ‘বড় ফণী’ নামে। এক ডাকে সবাই তাঁকে চিনতো। অবাক হলাম এতদিন এখানে রয়েছি, কারুর কাছে তো এনার নামটুকুও শুনি নি। অথচ ইনিই প্রথম যাত্রাদলের অভিনেতা হিসাবে অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পেয়েছেন, সে নাকি বিষম সম্মানের ব্যাপার, প্রবোধবন্ধুর কথা অনুসারে। খোঁজখবর করতে শুরু করলাম। জানা গেল, সত্যিই ইনি থাকতেন এখানে। মারা গেছেন বহুদিন হল। সম্প্রতি তাঁর বাড়ি ভেঙ্গে প্রমোটার ফ্ল্যাট তুলে ফেলেছে। ঠিকই তো, ইনি এমন কেউ তো নন যে তাঁর বাড়ি হেরিটেজ সাইট বলে স্বীকৃত হয়ে সংরক্ষিত হবে, কাজেই বেশ করেছে প্রমোটার বাড়ি ভেঙ্গে ফেলেছে।

কিন্তু এই অ্যাকাডেমি পুরষ্কারটা কি বস্তু? জানার আগ্রহ তো রয়েই গেল। কেউ বলতেই পারল না জিনিসটা আসলে কি ছিল। 

যাত্রাসম্রাট শান্তিগোপাল
এককালের সেই বিখ্যাত নায়কের উত্তরপুরুষদের খবরও পেলাম। তাঁদের মধ্যে যিনি ‘বিখ্যাত’ হয়েছেন, পরিচয় পেতে বুঝলাম তাঁকেও চিনি ছোটবেলা থেকেই। লম্বা ঝাঁকড়া চুলের এক কিশোরকণ্ঠী আনন্দবাজারে ২"x২" বিজ্ঞাপন করতেন নিজের অনুষ্ঠানের, জ্যোতিষীদের আর হারানো প্রাপ্তি বিজ্ঞাপনের পাশে নিয়মিত দেখতে পেতাম সেই বিজ্ঞাপন - এখন আর দেখতে পাই না, তিনিই এনার নাতি। যাত্রা করাকে ‘গান করা’ বলা হত, ইনিও গান করতেন, যাত্রাগান নয়, সিনেমার গান। এখনও করেন। দাদুর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারেন নি, তবু গ্ল্যামার জগতে থাকার চেষ্টা করেছেন অনেকদিন। আর পারছেন না, যৌবনের প্রান্তে পৌঁছে এখন ক্ষয়া খর্বুটে চেহারা নিয়ে প্রায় বিনি পয়সার বিজয়া সম্মিলনী করে বেড়ান ক্লাবে ক্লাবে। চড়া বাদ্যযন্ত্রের সাহায্য নিয়ে নিজের দুর্বল গলাকে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা ফলপ্রসূ হয় না বলে কিশোরী কন্যাকেও আজকাল নিজের সাথে নিয়েছেন, যদি সুদিনের দেখা পাওয়া যায় সেই আশায়। 

রূপালী পর্দার গ্ল্যামার যাত্রাজগতে কখনোই ছিল না, তবু বহু মানুষ সেই জগৎকে আঁকড়ে ধরেছেন। শুধু পেশার কারণে নয়, অনেকেই তার মধ্যে নেশার কারণেও। ফল কি হয়েছে? অধিকাংশকেই কেউ মনে রাখে নি। মুষ্টিমেয় কিছুজন সাময়িক প্রচার পেয়েছেন, বিখ্যাত হয়েছেন, তারপরে বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছেন। একসময়ের বিখ্যাত সেই মানুষের আত্মীয় পরিজন বলে তাঁদের উত্তরপুরুষদের এখন কেউ খোঁজখবরও রাখে না, কেউ তাঁদের কাছে জানতেও চায় না ‘তোমার অমুক নটসূর্য ছিলেন নাকি?’, বা ওই জাতীয় কোন প্রশ্ন। 

আচ্ছা, কার পূর্বপুরুষ কবে কতটা বিখ্যাত হয়েছিলেন, তা আমাদের জেনেই বা কি লাভ, তা নিয়ে লিখেই বা কি লাভ, ঠিক না? তার চে’ বরং যা লিখব ভেবেছিলাম তাই লিখি।

জীবনে ক’টা পেশাদারদের করা যাত্রাপালা দেখেছি? দেখি তো গুনে, শান্তিগোপালের ‘রণাঙ্গনে নেতাজী’ ছাড়া আর কোনটারই তো দেখছি নাম মনে পড়ছে না! মনে হয় এক আঙ্গুলের কড় গুনলেই আমার জীবনে দেখা সব যাত্রা পালার সংখ্যা গুনে ফেলতে পারব।

গ্রামে ছোটবেলার অনেকটা সময় কাটিয়েছি, প্রতি বছর শীতকালে সেখানে ম্যারাপ বেঁধে যাত্রার আসর বসত, তবু দেখার সুযোগ প্রায় হতই না । আসলে আমাদের পরিবার একটু রক্ষণশীল ধরণের ছিল। মনে হয় ঊষা উত্থুপের ‘রামা হো’ যতীন চক্রবর্তীর কানে তখনও যায় নি বলে অপসংস্কৃতি শব্দটির আবির্ভাব তখনও হয় নি। কিন্তু গোঁড়া পরিবারগুলির নিজস্ব কিছু ধ্যানধারণা ছিলই ‘সভ্য সংস্কৃতি’ বিষয়ে। অপসংস্কৃতি শব্দটি ব্যবহার না করেও বোঝান হত যাত্রা ভদ্রলোকে দেখে না। যাত্রা দেখতে যাওয়ার অনুমতি তাই পাওয়া যেত না, আগ্রহ যতই থাকুক না কেন। 

আগ্রহ হবে না? ফুটবল মাঠ ঘিরে ফেলে টিন দিয়ে ঘিরে বেশ মজবুত করে বিশাল প্যান্ডেল হত। চারিদিকে পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যেত, রঙ্গিন সব ছবি সুন্দর-সুন্দর মানুষ-মানুষীদের। যাত্রা শুরুর অন্তত এক মাস আগে থেকে গ্রামের মানুষের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত। ঘরের দাওয়া, চন্ডীমণ্ডপ, চায়ের দোকান, খেলার মাঠ, পুকুর ঘাট, রান্নাঘর- সর্বত্র তখন শুধু যাত্রার গল্প। 

ওই ছোটবেলাতেই সিনেমার পোস্টারে নায়ক-নায়িকাদের যে ছবি দেখতাম তার সাথে যাত্রার পোস্টারের নায়ক নায়িকাদের চেহারার পার্থক্য ধরা পড়ত। সিনেমার তারকারা যেন আকাশের চন্দ্র-সূর্যের মত-ধরা ছোঁয়ার বাইরের জগতের। তুলনায় যাত্রা দলের পোস্টারের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চেহারা যেন মাটির কাছাকাছির মানুষের মত, আশপাশে তাকালে এমন মানুষ দু-চারটে চোখে পড়ে। ফলে পোস্টার দেখলেই মনে হয় এতে যারা অভিনয় করে তারা আসলে রক্তমাংসের মানুষ, সিনেমার জগতের মত কল্পনার জগতের অধিবাসী নয়। সে জন্যেই হয়তো গ্রামের মানুষজনের কাছে যাত্রার জগতের এত আকর্ষণ ছিল। তখনো অবধি চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যাত্রার কাঁচা-কালো টাকার মধুর সন্ধান পান নি, পরে যখন তা পেলেন তখন এই সূক্ষ্ণ বিভেদটা আর রইলো না। বরং যাত্রার নট-নটিরা কোণঠাসা হয়ে পড়লেন, গ্রামের মানুষেরাও তখন ‘অমুক বইয়ের ওই নায়ক/নায়িকা এই পালায় আছে, দেখতে যাবি না?’-এই ধরণের চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করলেন। কেউ কেউ বলেন তখন থেকেই যাত্রা স্বকীয়তা হারিয়েছে। ধীরে ধীরে ভিডিও হল ও তারপরে কেবল টিভির দাপটে চলচ্চিত্রই গ্রামের মানুষের মুখ্য বিনোদনের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াল, যাত্রার আকর্ষণ কমে গেল অনেকটা। 

এসব পরিবর্তন তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে। কাজেই সেসব ছেড়ে আবার আশির দশকের প্রথমে ফিরে যাই। যা বলছিলাম, আমার যাত্রার জগতের সাথে যেটুকু পরিচিতি, তা কেমনভাবে হয়েছিল সেই কথাতে। 

শুধুই কি সচিত্র পোস্টারের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন? সাইকেল ভ্যানের উপরে মাইক নিয়ে বসে যাত্রার সশব্দ বিজ্ঞাপন করতে করতে যেত সংগঠক ক্লাবের ছেলেরা, কাছে গেলে লাল-হলুদ কাগজে ছাপা যাত্রার তালিকা পাওয়া যেত। হ্যান্ডবিলের লোভে গ্রামের বন্ধুরা ভ্যানের পেছনে পেছনে দৌড়ত। আমি কলকেতার ছেলে, আলাদা প্রেস্টিজ আছে, তাই ছদ্মগাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বন্ধুদের মত ভ্যানের পেছনে দৌড়তে বাধত, যদিও মনটা ওদের সাথেই ছুটতে থাকত। ভ্যান থেকে ঘোষণা শোনা যেত, অন্যান্য বিবরণের সাথে সিজন টিকিট কিনলে যে কত সস্তা পড়বে তার লোভ দেখানো হত বারবার করে। সাইকেল রাখার, পুরুষ-মহিলাদের আলাদা বসার সুবন্দোবস্ত আছে, তাও বলা হত। হ্যান্ডবিল নিয়ে ফিরে এসে উত্তেজিতভাবে বন্ধুরা আলোচনা করত, কে কোন যাত্রা দেখতে যাবে। বেশ আলোর কাজ, অস্ত্রশস্ত্রের ঝনঝনানি, ধুন্ধুমার সংলাপ দেখতে-শুনতে পাওয়া যেত বলে অধিকাংশেরই সামাজিক পালার থেকে ভাল লাগত পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক পালা। আমার কপালে কোনটাই নেই, ম্রিয়মাণ হয়ে বন্ধুদের আলোচনা শুনতাম শুধু। ওরা যাত্রা দেখতে যেত আর আমি দ্বিজেন্দ্রলালের নাটক পড়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতাম। 

বাঙ্গালীর দোষ হচ্ছে বাঙ্গালী সুযোগ পেলেই স্মৃতিচারণ শুরু করে, তা সে অপ্রাসঙ্গিক হলেও কিছু যায় আসে না। ভেবেছিলাম লিখব যাত্রার গল্প, লিখে চলেছি, যাত্রা না দেখার গল্প, সত্যিই একেবারে যা-তা।

***

সুন্দরবনে যাওয়ার আগ্রহ আমার অনেক দিনের। যতদূর জানি, সুন্দরবনের চল্লিশ শতাংশ মাত্র ভারতে, তারও শতকরা পনের কুড়ি ভাগ অংশে পর্যটকদের যেতে দেওয়া হয়। তার মানে কি হল? মোট সুন্দরবনের দশ শতাংশেরও কম দেখতে পায় একজন ভারতীয় পর্যটক, দুই রাত-তিন দিনের লঞ্চ চাপা ভ্রমণে। এমনি করে কি মনোজ বসু-আব্দুল জব্বার-সরলা বসু-‘বনবিবির বনে’র-‘বেদে বাউলে’ বা আরো সব প্রিয় লেখকদের সাথে বা তাঁদের লেখার চরিত্রদের সাথে পরিচয়ের সূত্রে সুন্দরবনকে দেখা-শোনার যে আগ্রহ তা মেটে? একেবারেই না। 

এখনকার সুন্দরবনে ঘোরা যেন তিনদিনের অবিরাম পিকনিক, বনজঙ্গলের মধ্যে ঢোকার কোন সুযোগ নেই, চওড়া চওড়া নদীর বুকে লঞ্চের উপর থেকে ছায়ার মত যা জালে ঘেরা জঙ্গলকে একটু আধটু দেখতে পাওয়া যায়, দু চারটে জন্তু জানোয়ার-পাখি দেখা এই পর্যন্তই। জঙ্গলের পরিবেশের সাথে কোন পরিচয়ই হয় না এমন ভাবে। এও অনেকটা যেন চিড়িয়াখানা ঘোরার মত, পার্থক্যের মধ্যে চিড়িয়াখানাতে জন্তু-জানোয়ারেরা থাকে জালের আড়ালে, এখানে তারা জঙ্গলে মুক্ত, বরং মানুষের গতিবিধির উপরে বাধা নিষেধ চাপানো থাকে-লঞ্চ থেকে নামা বারণ নির্দিষ্ট দুই-চারটে জায়গা ছাড়া। প্রচুর সুখাদ্য আর রঙ্গিন জলের সদ্ব্যবহার করতে করতে সারা দিন ঝিমোতে ঝিমোতে তাকিয়ে থাকা জাল দিয়ে ঘেরা জঙ্গলের দিকে, যেটুকু দেখতে পাওয়া যায় তাই নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে উত্তেজিত আলোচনা দিনের পর দিন।
ইচ্ছা করে লঞ্চ ছেড়ে নৌকায় করে সুন্দরবনের গভীরে যেতে, মৌলিদের সাথে, বাউলেদের সাথে, মাছমারাদের সাথে, কাঠুরেদের সাথে। পায়ে হেঁটে ভসভসে হাঁটু অবধি ডুবে যাওয়া কাদা মাড়িয়ে জঙ্গলে ঢুকতে। জঙ্গলের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে। কখনোই তা হওয়ার সুযোগ নেই। সেজন্যেই আগ্রহ থাকা সত্বেও সুন্দরবনে যেতে ইচ্ছা করে নি, অনেকবার সুযোগ এসেছে, তাও যাই নি।

বছর দুয়েক আগের শীতে স্ত্রী ও বন্ধু বান্ধবের চাপে আমার ধনুর্ভঙ্গ পণ আর রাখা গেল না। চললাম আরো জনা পঁচিশ সহযাত্রীর সাথে তিনদিনের সুন্দরবন ভ্রমণ কাম পিকনিকে।


কি দেখলাম? ভ্রমণ কাহিনী লিখতে বসি নি, কাজেই যা দেখলাম তার বিস্তারিত বর্ণনা দেব না। সত্যি বলতে এই তিনদিনের সুন্দরবনের ভ্রমণের বর্ণনা আপনারা চাইলে ব্লগে ব্লগে, ফেসবুকের পাতায় পাতায় শয়ে শয়ে পাবেন, তার বর্ণনা আবার লেখার ইচ্ছা নেই। বরং যা যা মনে রয়ে গেল, তাই এবার বলি।
বিশাল চওড়া চওড়া নদী, তাতে অগাধ জল- নিস্তরঙ্গ নদীতে শীতের আরামদায়ক রোদ্দুর গায়ে মেখে নৌকাবিহার (মানে লঞ্চ বিহার আর কি!) সব সময়ে আরামদায়ক। এখানেও তাই। নদীর বুকে জঙ্গল এগিয়ে এসেছে, তার মাথায় আকাশ রঙ্গিন করে সূর্যাস্ত হচ্ছে, খাসা লাগল দেখতে। জঙ্গলের কাছ দিয়ে লঞ্চ যখন চলে, ফুট পঞ্চাশেক দূর থেকে জঙ্গলের গাছপালার সাথে সারেং পরিচয় করিয়ে দেন যখন, তাও ভাল লাগল। 

গোসাবাতে হ্যামিল্টন সাহেবের বাংলোর কথা না বললে বন্ধুরা রাগ করবেন। বাইরে থেকে বাংলোটি দেখে, তালা লাগানো দাওয়ার তলায় দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের নাম স্মরণ করতেই হয়। রবীন্দ্রনাথ এখানে এসে থেকেছেন, কি কি করেছেন, কি কি খেয়েছেন সেসব এত জায়গায় পড়েছি, মনে পড়ছিল অনেক কিছুই। তার একটুখানি আপনাদেরও মনে করিয়ে দিই, ভারী কিছু নয়, রবীন্দ্রনাথের খাওয়াদাওয়ার বিবরণটুকুই শুধুমাত্র। আসলে এখনকার সুন্দরবন ভ্রমণ মানে তো শুধু খাওন-দাওনের গল্পই, সেখানে ভারী কিছু আনলে হজম হওয়া মুশকিল, অতএব...
হ্যামিলটন সাহেব-এর বাংলো
‘...দেবতার মত চেহারা বাবু। চোখ দুটো সর্বদা হাসত। গায়ে জোব্বা। ধবধবে দাড়ি। তিনদিন ছিলেন। সারাদিন গান আর গান। খুব ভোরে উঠতেন...বাবুর্চিরা জাতে দোসাদ, চামার-বিহারের বালিয়াতে বাড়ি। রবীন্দ্রনাথের কোন বাছবিচার ছিল না...

...চায়ের পর ফল খেতেন। কলকাতা থেকে আনানো কমলা, নাশপাতি আর গোসাবার কলা। দুপুরে ভাত। আমরা যেমন থালার উপর ভাত সাজিয়ে দিই, রবীন্দ্রনাথের তা চলত না। লম্বা ফালি, একখানা পিঠের মত, থালার উপর ভাত সাজানো থাকত। সঙ্গে এক বাটি ঘন মশুরীর ডাল। টমেটো ও লেটুস পাতার স্যালাড। আর একখানা ভাপে সেদ্ধ করা আস্ত ভেটকি মাছ।খানিকটা তরকারী।...’ (বনে বনে - তাপস গঙ্গোপাধ্যায় ও পিনাকি চট্টোপাধ্যায়)


আব্দুল জব্বারের লেখায় হ্যামিল্টন সাহেবের পরিবার সম্পর্কে যে সব অপবাদ পড়েছি, তাও যে কতটা সত্যি কে জানে।

শিবশঙ্কর মিত্রের লেখায় এখানকার গরীব গ্রামবাসীদের সমবায় আন্দোলনের কথাও বেশ মনোগ্রাহী। আরো কত আলোচনা পড়েছি এই ছোট্ট গ্রামটা সম্বন্ধে। 

গোসাবার লঞ্চঘাট থেকে এই বাংলো যাতায়াতের পথটি ইঁটের, দুপাশে ছোটখাটো দোকানপাট। গ্রামের দিকে যেমন টিনের বা টালির বা অল্প হলেও কখনো সখনো খড়ের চাল দেওয়া টিনের বা চেটাই-এর ঘর দেখা যায় তেমন সব ঘর। ধরুন আপনি বাসে চেপে গ্রামের মাঝ দিয়ে চলা রাজপথ ধরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন, দীঘা-তাজপুর বা অন্য কোথাও, বাস স্ট্যান্ডে পথের ধারে তাকালেই এমন সব দোকান চোখে পড়বে আপনার, চায়ের দোকান-পানের দোকান-চুল ছাঁটার সেলুনের বা ওই জাতীয় অন্য কিছুর। দোকানদারের বেসাতি নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, আমার বক্তব্য ওই দোকানের বাইরের টিনের দেওয়াল বা চেটাইয়ের বেড়াটুকু জড়িয়ে।

ওগুলো পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ থাকবেই। রাজনৈতিক ইস্তাহার, হাতুড়ে ডাক্তারের বিজ্ঞাপনের সাথে সাথে যাত্রার বা সিনেমার পোস্টার।

সিনেমার নামগুলির সাথে তো খবর কাগজের সৌজন্যে আমরা পরিচিত, কাজেই তারা তেমন আকর্ষণ করে না। আকর্ষণ করে যাত্রার পোস্টারগুলো। আহা, পোস্টার আলো করে থাকা কি সব যাত্রার নাম! মনে করিয়ে দেব দু-চারটে? ‘কালবৈশাখী ঝড়ে/বৌমা এলো ঘরে’, ‘আমি বিংশ শতাব্দীর বিষ’, ‘বাবা কেন আসামী’, ‘অন্ধ গলির বন্দী পাখি’ এমন আরো কত চটকদার নাম। শুধু নাম দিয়েই দর্শকদের মনে আগ্রহ জাগিয়ে তোলার এই যে পালাকারদের ক্ষমতা, তার প্রশংসা করতেই হয়, তাই না? 

আমার তো নামগুলো দেখলেই ইচ্ছা করে বাস থেকে নেমে দৌড়ে আসরে চলে যাই, গিয়ে দেখি কি হচ্ছে। কিন্তু দু:খের বিষয় তেমন সুযোগ কোন বারেই হয় না, কখনই আর যাত্রা দেখার সুযোগ আসে না। হয় তারিখে মেলে না নাহলে সঙ্গীদের অনাগ্রহের কারণে। তবু বাসে উঠে একটু গ্রামের দিকে গেলেই আমার চোখ খুঁজে বেড়ায় এমন সব পোস্টার, ঘ্রানেন অর্ধ ভোজনের মত দৃশ্যেন অর্ধদর্শনম(ভুল ধরবেন না প্লিজ, কি বলতে চাইছি মানেটুকু বোঝাতে পারলাম তো, সেটুকুই যথেষ্ট!), যেখানে দেখতে পাব ‘রক্তে রাঙ্গা পায়রাডাঙ্গা’( ©দুলেন্দ্র ভৌমিক বা সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়, ঠিক মনে পড়ছে না, শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিকেরা এই অর্বাচীনের অপরাধ ক্ষমা করবেন।) ধরণের যাত্রাপালার নাম। সচরাচর আমার চোখ ব্যর্থ হয় না।

এই গোসাবাতেও ব্যর্থ হয় নি। ‘বাবুগো, সিঁদুরের দাম অনেক’। চারিদিকে ওই দোকানগুলোর গায়ে রঙিন রঙিন পোস্টার চোখে পড়ল, মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। গোসাবাতেই যাত্রার আসর বসেছিল, এক গুচ্ছ এমন বাছা বাছা নামের যাত্রার মধ্যে এই নামটাই চোখকে টানলো। লঞ্চঘাটের সামনের ফুটবল মাঠে এখনো সেই আসরের কঙ্কাল পড়ে আছে। মনটা আবার উসখুস করে উঠলো। কিন্তু কিছু করার নেই, কয়েকদিন আগেই আসর ভেঙ্গে গেছে, না ভাঙ্গলেও লাভ হত না, কারণ আমরা এখানে রাতে থাকব না।

সুন্দরবনে যাঁরা যান তাঁদের সবার থাকার ব্যবস্থা এখন মোটামুটি পাখিরালা গ্রামেই হয়। জায়গাটা বেশ জমজমাট হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোসাবাতেও যেমন. এখানেও তেমন ধারেকাছে জঙ্গলের নামগন্ধ নেই। যাতায়াতের সুবিধা আর আধুনিক হোটেলের কারণে ট্যুরিস্টদের কাছে সুন্দরবনের আকর্ষণ দিন দিন বাড়ছে।


তাদের জন্যে নানান সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করতে গিয়ে মনে হয় জঙ্গলের দফারফা করতে হয়েছে। গুচ্ছ গুচ্ছ তিনতলা চারতলা হোটেলের সাথে কটেজ ধরণের হোটেলেরও অভাব নেই। প্রচুর জেনারেটররের আওয়াজ চতুর্দিকে। চারদিকের আধপচা ডোবাগুলো আবর্জনায় ভর্তি।এই এতটুকু জায়গায় এত মানুষের ভিড়, ফলে চারদিক যতটা সম্ভব অপরিষ্কার। দূষণ নিয়ে মাথাটাথা কেউ ঘামায় বলে মনে হয় না। অনেকে আবার নদীর বুকে লঞ্চেই রাত কাটায়। নদীর উপরে শ’খানেকের উপর লঞ্চ যে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে যে মানুষগুলো রয়েছে তাদের বর্জ্যে নদীর জল কতটা নোংরা হচ্ছে তা নিয়ে পর্যটন দপ্তর কিছু ভাবছেন কি? জানা নেই। 

শুধু গ্রামের দূষণের কথা ভাবছেন? সবাই জানেন সুন্দরবন ভ্রমণের মাধ্যম কেবলমাত্র লঞ্চ বা বড়সড় ভটভটি, যাকেও পর্যটকেরা লঞ্চই বলে থাকেন। এই যে হাজার হাজার মানুষ নদীর বুকে বারো থেকে চব্বিশঘণ্টা কাটান, নদীগুলির জল এতে কতটা দূষিত হয় তা নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা শুরু না করলে কিছুদিনের মধ্যেই এই নদীগুলির হালও কলকাতার মাগঙ্গার মতই হবে!

লঞ্চে যতক্ষণ থেকেছি, দুই-একবার চোখে পড়েছে তীরে জঙ্গলের গায়ে গাছের ডালে লাল কাপড় ঝুলছে, বইতে পড়েছি কোথাও বাঘে মানুষ নিলে এমন কাপড় তার সঙ্গীসাথীরা ঝুলিয়ে রেখে আসে, এখানেও কি তাই? হবে হয়ত। কাপড় তো কিছুদিন পরেই পচে মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু থারমোকলের থালা-বাটি? চোখে পড়েছে সর্বত্র থারমোকলের থালা জঙ্গলের গায়ের জালে আটকে আছে। কি যে দৃষ্টিকটু লাগে সবুজ জঙ্গলের বুকে সাদা এই থালা বাটিগুলোর উপস্থিতি। শুধুই কি দেখতে খারাপ লাগে? এই বস্তুগুলোর অসীম জীবনী শক্তি। কতদিন ধরে যে এগুলো এখানকার পরিবেশ দূষিত করবে তা ভগবান ছাড়া আর কেউ বলতে পারবেন না। 

পাখিরালা গ্রামে আমাদের ট্যুর অপারেটর প্রথম রাতটুকুর থাকার ব্যবস্থা করেছিল এক তিনতলা বড়সড় হোটেলে, লঞ্চঘাট থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। হোটেলের সামনের প্রাঙ্গনটি ফুলবাগান দিয়ে ঘেরা। তার মাঝে একটা প্যান্ডেল। প্যান্ডেলে একটা ছোট্ট ১০'x১০' স্টেজ করে রাখা রয়েছে। স্টেজের পেছনদিকটা শুধু ঘেরা, বাকি তিনদিক খোলা। এপাশে ওপাশে যাত্রার বিজ্ঞাপন। যা: বাবা, এই প্যান্ডেলে তো শ’খানেকের বেশী দর্শক বসতে পারবে না, এখানে আবার যাত্রা হবে কি করে?আজ অবশ্য যাত্রার কোন উদ্যোগ এখানে চোখে পড়ছে না, হয় আগে হয়ে গেছে, নইলে পরে হবে বলে প্যান্ডেল খোলা হয় নি বা বাঁধা হয়েছে বলে মনে হল। 

সন্ধ্যার মুখোমুখি হোটেলে মালপত্র রেখে চপ-টপ সহযোগে চা পান করে লঞ্চঘাটের দিকে ঘুরতে গেলাম। গোসাবার মতই এই গ্রামেও আট-দশ ফুট চওড়া এবড়োখেবড়ো ইঁটের রাস্তা। দুপাশে প্রচুর দোকানপাট। চাইনিজ খেলনা, তেলেভাজা, সাদা বা সোনালী রঙের মধু(দোকানদারেরা চেঁচাচ্ছে ‘আসুন পদ্মমধু নিয়ে যান, আসুন গরানফুলের মধু নিয়ে যান!’ বলে।), জামাকাপড়, আরো পাঁচরকম জিনিসের দোকানে মানুষ গিজগিজ করছে। বাঙ্গালী বেড়াতে গিয়ে কেনাকাটা করতে ভালবাসে, ফিরে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে উপহার দিতে হবে তো! এখানে এমন কিছু নেই যা কলকাতায় পাওয়া যায় না, তাতে কি হয়েছে-‘যা পারি কিনে তো নিয়ে যাই, বলা যাবে সুন্দরবন থেকে তোমাদের জন্যে নিয়ে এসেছি’, অতএব দোকানপাটে পা ফেলার জায়গা নেই, সরু রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ।

মাছের বাজারও বসেছে এর মধ্যেই। ইলিশ-ভাঙ্গন-চিংড়ি-পার্শে-ভেটকি, এমন জিভে জল আনা মাছ সবই রয়েছে, কিন্তু দাম যা দেখলাম, ওরে বাবা, কলকাতার থেকেও বেশী। হবে না? এত ট্যুরিস্ট ভিড় করলে দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক।

তার মধ্যে দিয়েই মাঝে মাঝে সাইকেল ভ্যান প্যাঁক প্যাঁক করতে চলেছে, ভিড় কাটিয়ে, কখনো মালপত্র নিয়ে, কখনো মানুষজনকে সওয়ারী বানিয়ে। মানুষ যাত্রীদের মধ্যে মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে মাথায় মুকুট, জরি লাগানো জমকালো রাজরাজড়ার সাজপোশাক পরে ভ্যানের উপরে গুঁতোগুঁতি করা নারী পুরুষ। এরা আবার কারা? 

মাথায় এল, তার মানে আশপাশে কোথাও নাটক বা যাত্রার আসর বসেছে। গ্রামের অপেশাদার শখের যাত্রা বোধ হয়, তাই পয়সাকড়ি হাতে একেবারেই নেই, যেখানে পালা হবে সেখানে সাজঘরও নেই, এমনি করেই কোনরকমে গ্রাম থেকেই সেজেগুজে ভ্যানে করে আসরে যাচ্ছে বোধহয়। বাঃ, এতো দারুণ, আজ সন্ধ্যায় তো কিছু করার নেই, কোথায় যাত্রা হচ্ছে জানতে পারলে বেশ দেখতে যাওয়া যায় তো! 

চটপট হোটেলে ফিরে দলপতির কাছে অনুমতি চাইতে গেলাম। বয়স্ক মানুষ। ইনি পাহাড়েও আমার দলপতি থাকেন কখনো সখনো, তাই দুজনে দুজনকে একটু সমঝে চলি। 

তিনি গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘কাল ভোরে বেরোনো, আজ যাত্রা দেখতে যাওয়া যাবে না।‘
‘ইচ্ছে করছে যে!’
‘খুব ইচ্ছে করছে?’
‘ভীষণ!’

ভদ্রলোক হাসলেন, ‘দাঁড়াও দেখছি কি ব্যবস্থা করা যায়। এখন খেয়ে নাও, দুপুরে পারশে আর ভেটকি খেলে তো, এবেলা তাই আর মাছ নয়, মুরগীর ব্যবস্থা হয়েছে দেখলাম।‘

পরদিন ভোরবেলা লঞ্চে উঠে সারাদিন টো টো করে ঘুরে আবার ফিরে এলাম সেই পাখিরালা গ্রামেই। নেহাৎ শীতকাল, তাই শরীর ক্লান্ত হচ্ছে না। গরমে এমন ঘুরলে পাগল হয়ে যেতে হত।

আজ আগের দিনের হোটেলে নয়, নতুন আরেকটা হোটেলে ঠাঁই হল আমাদের। খোলামেলা হোটেল, বিশাল উঠোন ঘিরে একতলা ছোট ছোট কটেজ। নামেই কটেজ, আসলে ছোট ছোট পাকা বাড়ি। আশ্চর্য ব্যাপার, এখানেও দেখি লম্বাটে উঠোনের একপ্রান্তে স্টেজ, সেই একই সাইজের, মোটামুটি ১০'x ১০'। স্টেজ বলতে কিন্তু প্ল্যাটফর্ম জাতীয় কিছু নেই, মাটির উপরে চট বেছানো, তিন দিক খোলা। যাব্বাবা, এখানেও যাত্রা হবে নাকি? এতো অবাক কাণ্ড, যাত্রা তো আমরা জানি মাঠে প্যান্ডেল-ফ্যান্ডেল করে হয়, সব হোটেলে এমন যাত্রার জন্যে স্টেজ, ব্যাপারটা কি?

রহস্যের সমাধান করতে ট্যুর অপারেটর ভদ্রলোককে চেপে ধরলাম। উনিই ব্যাপারটা খোলসা করলেন।

পাখিরালা গ্রামের যেগুলো একটু বড় হোটেল, সবগুলোতেই এমন পাকাপাকি ভাবে বানিয়ে রাখা স্টেজ আছে। টুরিস্টরা মূল্য দিয়ে পালা দেখতে চাইলে হোটেলের কেয়ার টেকার দল ডেকে যাত্রার ব্যবস্থা করেন। খুব সামান্য খরচ, আর ওই হোটেলে যারা আছেন তাঁরাই শুধু এই যাত্রা দেখতে পারেন, মানে অনেকটা প্রাইভেট অডিয়েন্স আর কি। এই গ্রাম আর আশপাশে বেশ কিছু ছোটখাটো দল আছে, ফোন করে ডাকলেই তারা এসে যাত্রা শুনিয়ে চলে যায়।
বুঝতে পারলাম গতকাল ভ্যানে করে এই সব যাত্রার কুশীলবেরাই হোটেলে হোটেলে যাচ্ছিলেন। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সে বা পুরুলিয়ার গ্রামে যেমন পর্যটকদের জন্যে আদিবাসী নাচের বন্দোবস্ত হয়, এও তেমন।

কথা শেষ করে ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ‘যাত্রা দেখতে চেয়েছিলেন আপনি? ব্যবস্থা করে ফেলেছি।‘

আমি তো দারুণ খুশী, কত বছর পরে আবার যাত্রার আসরে বসার সুযোগ হবে।

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ গোটা দুই-তিন ভ্যান ভর্তি করে যাত্রাদলের লোকজনেরা সব হাজির হল, অনেকে বেশ সাজগোজ করে, বাকিরা সাধারণ পোশাকে। 
আলোর ব্যবস্থা, শব্দের জন্যে স্পীকার-টিকারের ব্যবস্থা করে আটটা নাগাদ যাত্রা শুরু হল, জনা তিরিশ দর্শকের সামনে। আরম্ভের আগে বলে দেওয়া হল জসিমুদ্দিনের গল্পের উপর নির্ভর করে এই যাত্রাপালার নাম ‘দুখিনী মায়ের ছেলে দুখে’। 
যাঁরাই সুন্দরবনের উপর একটু আধটু পড়াশুনো করেছেন তাঁরা সকলেই জানেন এই গল্প। বনবিবি আর দক্ষিণরায়ের বিবাদ ও সন্ধি। জসিমুদ্দিনের লেখা এই গল্প আমি পড়ি নি, আদৌ কি পল্লীকবি এমন গল্প লিখেছিলেন? এই যে গল্প, এতো উপকথা হিসাবে স্মরণাতীত কাল থেকে সুন্দরবনের ঘরে ঘরে সমাদৃত, তাহলে রচয়িতা হিসাবে জসিমুদ্দিনের নাম নেওয়া কেন? 
ছোট করে গল্পটা বলে দিই। সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামের কিশোরবয়স্ক ছেলে দুখে ও তার মায়ের অতি অভাবের সংসার। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই তাদের একেবারে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা চলছে। বেশ কিছুদিন এমন চলার পরে দুখের বাবার পরিচিত ধনী ব্যবসায়ী ধনা তাদের গ্রামে এলো। সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল থেকে কাঠ, মধু সংগ্রহ করে নিয়ে আসার ব্যবসা তার। ধনার জানা ছিল না দুখের বাবা মারা গেছেন। সে খুব দু:খিত হল ওদের দুর্দশা দেখে। দুখের মাকে বলল সে দুখেকেও তার ব্যবসায় নিতে চায়। দুখের মায়ের খুব আপত্তি ঐটুকু ছেলেকে জঙ্গলে পাঠানোর, সেখানে হাজার বিপদ, জলে কুমীর-ডাঙ্গায় বাঘের হাতে বেঘোরে প্রাণ হারানোর সমূহ সম্ভাবনা পদে পদে। দুখে কিন্তু ধনার প্রস্তাবে খুব উৎসাহী হয়ে পড়ল, সংসারের অভাব দূর করার জন্যে মায়ের পেছনে লেগে থেকে ধনার সাথে জঙ্গলে যাওয়ার অনুমতি আদায় করলো। মা কাঁদতে কাঁদতে তাকে জঙ্গলে যাওয়ার অনুমতি দিলেন, সঙ্গে জঙ্গলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বনবিবিকে কাতর অনুরোধ করলেন দুখেকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে।

গভীর জঙ্গলে পৌঁছে সকলে কাঠ কাটতে গেছে, দুখে একা রয়েছে নৌকায়। তার উপরে দায়িত্ব রান্নার বন্দোবস্ত করার, সবাই ফিরে এসে খাবে। ঠিক তখন দক্ষিণরায়, বাঘেদের রাজা, এসে উপস্থিত দুখেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। দুখে বাড়ি না ফিরলে তার মায়ের এই জগতে নিজের বলে আর কেউ রইবে না, দুখের এই আকুতিতে কর্ণপাত করতে রাজি নয় সে। প্রাণভয়ে দুখে বনবিবির আরাধনা করতে শুরু করলো। বনবিবি ভক্তকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে অকুস্থলে আবির্ভূত হলেন। তাঁর চেলা কালু খাঁর সাহায্যে দক্ষিণরায়কে যুদ্ধে পরাভূত করে তাঁর বাহন কুমীরের পিঠে চাপিয়ে দুখেকে তার মায়ের কাছে ফেরৎ পাঠিয়ে দিলেন। আর কখনো বনবিবির কোন ভক্তের উপরে অত্যাচার করবে না বলে অঙ্গীকার করে দক্ষিণরায় বনবিবির বশ্যতা স্বীকার করলো।
এতো গেল গল্পের চুম্বক। আসল মজা তো যাত্রার অভিনয় আর অন্যান্য অনেক কিছুতে। 

পেছনের পর্দা ঠেলে হাফ প্যান্ট পরা দুখে যখন মঞ্চে এলো, আমরা কয়েকজন হেসে উঠলাম, হায়রে, এ কোন অতীতের গল্প, তখন হাফ প্যান্ট পেল কোত্থেকে ছেলেটা? 

মঞ্চের উপরে গোটা কয়েক মাইক ঝুলছে, অভিনেতা/অভিনেত্রীরা সংলাপ বলার জন্যে বা গান করার জন্যে ঠিক তার তলায় এসে দাঁড়াচ্ছে, নইলে দর্শকেরা কিছু শুনতে পাবে না যে! আবার সে মাইকের এমনি ক্ষমতা, একেবারে মাইকে মুখ ঠেকিয়ে না দাঁড়ালে তার কন্ঠস্বর আমাদের কানে পৌঁছচ্ছে না। কাজেই যাঁরা অভিনয় করছেন তাঁরা দশকদের দিকে তাকিয়ে সংলাপ বলছেন না, বলছেন শামিয়ানার দিকে তাকিয়ে, কি করা যাবে, মাইক যে উপর থেকেই ঝুলছে। 

পর্দা ঠেলে অভিনেতা/অভিনেত্রীরা যখন মঞ্চে পা দিচ্ছে, পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নেপথ্যে বাকিরা বসে বসে গল্প করছে বিড়ি মুখে নিয়ে। জমকালো পোশাক-মুকুট-গালপাট্টাওয়ালা একটু আগেই মঞ্চে হাঁকডাক সহযোগে অভিনয় করে যাওয়া দক্ষিণরায়ের মুখে বিড়ি, ভাবুন তো একবার, কেমন চমকলাগানো দৃশ্য!

নাচতে নাচতে মাঝে মাঝে বাজনদারদের গায়ের কাছে চলে আসছে অভিনেতারা, কি আর করবে, এই তো ছোট্ট মঞ্চ, সেখানে নাচ করার জায়গা কোথায়? ভয় লাগছে হয়তো সব সমেত আছাড় খাবে, না: তেমন দুর্ঘটনা একবারও ঘটে নি মা বনবিবির আশীর্বাদে! 

দুখে রান্না করবে, সেখানে একটু আলোকসজ্জার কায়দা দিয়ে দর্শক মনোরঞ্জনের ইচ্ছা ছিল মনে হয় পরিচালকের। কয়লার যে উনুন হয় না, তেমন একটা প্রথম থেকেই মঞ্চের সামনে রাখা ছিল। কয়লার উনুন ওই সময়ের সুন্দরবনে কোত্থেকে এলো, সেসব ভাবলে চলবে না কিন্তু, এখন ওই উনুনে আগুন জ্বলবে, সেটাই খেয়াল করুন। কি করে? ভেতরে লাল রঙের আলো জ্বলে। এই রে, সে আলো যে জ্বলে আর না, মনে হয় তার-টার ছিঁড়ে গেছে। উনুন না ধরলে রান্না হবে কি করে? রান্না না এগোলে গল্প এগোবে কি করে? অতএব, যাত্রা বন্ধ করে কম্ফর্টার আর চাদর মুড়িসুড়ি দেওয়া পরিচালক, থুড়ি অধিকারী মহাশয় ইলেকট্রিকের তার ধরে টানাটানি করতে শুরু করলেন। সে কি আর ঠিক হয়! পেছন দিক থেকে দুখের বিধবা মা, যাঁকে এতক্ষণ সাদা কাপড় পরে মঞ্চে করুণ সুরে গান গাইতে শুনেছি উচ্চগ্রামে, অধিকারী ভদ্রলোকের সাহায্যে একেবারে মঞ্চের সামনে চলে এলেন। শীতের রাত, কাপড়ে আর শীত মানাচ্ছে না, অতএব একটা জ্যাকেট সেই কাপড়ের উপরে চড়িয়ে। বেশ খানিকক্ষণ তিনিও চেষ্টা করলেন, ততোক্ষণ দুখে মঞ্চে চুপচাপ বসে রইল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, আলো আর জ্বলল না, আগুন আর ধরল না। অতএব উনুনে লাল আলো জ্বলার স্পেশাল এফেক্ট দেখার সৌভাগ্য আমাদের আর হল না! দুখের মা মাথা নেড়ে মঞ্চের পেছনে চলে গেলেন, অনতিবিলম্বে আবার মঞ্চে গান গাইতে গাইতে অবতীর্ণ হলেন, না জ্যাকেট তখন আর তাঁর গায়ে নেই!

যে কুমীরের পিঠে চেপে দুখে মায়ের কাছে ফিরে এল, সে আসলে কুমীরের পোশাক পরা একজন বুকে হাঁটা মানুষ, একই রকম ভাবে দক্ষিণরায়ের বাঘও হাজির হল মঞ্চে, বাঘের মুখোশ পরা হামাগুড়ি দেওয়া একজন। 

দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পল্লীচিত্র সিরিজের বইতে যাত্রার বিবরণে প্যালা দেওয়ার রীতির কথা পড়েছি, অন্যত্রও পড়েছি। সেই প্যালা দেওয়ার প্রচলন যে এখনো আছে জানা ছিল না। যাত্রার মাঝে মাঝে কিছুক্ষণ পর পর বিভিন্ন অজুহাতে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দর্শকদের কাছে প্যালা নিতে আসছে। যেমন ধরুন, দুখে যাবে জঙ্গলে, তার আগে তার মা তাকে একটু ভালোমন্দ রেঁধে খাওয়াবেন, কিন্তু অভাবের সংসার-সামর্থ্য নেই, সেজন্যে তিনি দুখের হাত ধরে আঁচল পেতে দর্শকদের মধ্যে এসে ঘুরে প্যালা সংগ্রহ করে নিয়ে গেলেন। সেই পয়সায় রেঁধে বেড়ে খাইয়ে দুখেকে জঙ্গলে পাঠালেন। দুখে জঙ্গলে গেছে, তার মঙ্গল কামনায় দুখের মা বনবিবির পুজো দেবেন, আরেকবার দর্শকদের মধ্যে ঘুরে প্যালা আদায় করে ফেললেন। এমনি ভাবে বার পাঁচেক আমরা প্যালা দিলাম, খুশী হয়েই, একে আপনারা কেউ হয়তো বখশিস বলতে পারেন, কিন্তু আমার কাছে পুরনো প্যালা কথাটাই বেশী পছন্দের।

গরম গরম সংলাপ, চড়া সুরের গান(একটি গানের সুরও সিনেমার সুরের নকলে নয়), লাল-নীল-সবুজ রঙের আলোর কারিকুরি, হারমোনিয়াম-বাঁশির প্যাঁ-পোঁ, অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের ঝ্যাং ঝ্যাং, দুমদাম আর এমন নানান ঘটনা দিয়ে যাত্রা শেষ হল যখন তখন বাজে প্রায় দশটা। 
যদি বলেন, কেমন লাগল দেখতে? আমি এককথায় বলব, দারুণ। পুরো সুন্দরবন ট্যুরের মনে রাখার মত ঘটনা আমার এই যাত্রা দেখার অভিজ্ঞতা। 

বন্ধুরা হয়তো নাক সিঁটকোবেন, ঈশ, এই লোকটার রুচিবোধ বলে কিছু নেই, কি সব গেঁয়ো চিৎকার করে পার্ট বলা দেখে আর বেসুরো গান শুনেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ! ঠিকই হয়তো বলবেন তাঁরা, কিন্তু কি জানেন, পরিবেশ বলে একটা ব্যাপার আছে, শীতের রাতে, চারপাশে ঘন অন্ধকারের মধ্যে(লজের আলো সব নেবানো ছিল) এই যাত্রার ত্রুটিপূর্ণ অভিনয় আর হাস্যকর কাজকারবারে সত্যিই ভীষণ মজে গেছিলাম। এও সত্যি, কলকাতার বুকে আমাকে কেউ এই যাত্রা দেখাতে গেলে আমি পাঁচ মিনিটও সহ্য করতে পারব না, কিন্তু এখানে পুরোটাই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম। শুধু আমারই কি ভালো লাগলো? না, সঙ্গীদের সকলেই খুব খুশী যাত্রা দেখে। এমনকি, আমাদের সঙ্গে এক সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ছিলেন, অবাঙ্গালী, দিল্লীতে থাকেন, বাংলার বিন্দুবিসর্গ বোঝেন না, তিনিও দেখি যাত্রার শেষে অধিকারীর সাথে কথা বলছেন, প্রশংসাসূচক কথা। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি তো গল্পের কিছু বুঝলেন না, কি ভাল লাগল আপনার? উনি বলেছিলেন ওনার ‘এনভায়রনমেন্ট’টা খুব পছন্দ হয়েছে।

যাত্রার জনপ্রিয়তা আগের থেকে অনেক কমে গেছে। টিমটিম করে যেটুকু এখনো বজায় আছে তাও ওই চলচ্চিত্র বা টিভির তারকাদের উপস্থিতির কারণে। আগে চোখে পড়ত পাতার পর পাতা জুড়ে খবর কাগজে যাত্রার বিজ্ঞাপন, এখন তেমনটা আর চোখে পড়ে না। নটসূর্য এই-যাত্রালক্ষ্মী ওই এমন নামে এখন আর কাউকে আমরা চিনি না। বলুন তো এখনকার কোন বিখ্যাত পালাকারের নাম? বলুন তো বিখ্যাত কোন নট-নটির নাম, পারবেন না। অথচ আগে যাত্রা দেখি বা না দেখি, এমন অনেক নামই আমাদের জানা থাকত।

এমনি করেই হয়তো এক সময়ে পেশাদার যাত্রা শেষ হয়ে যাবে নতুন ধরণের বিনোদনের চাপে, বাংলার লোকশিল্পের প্রাচীন একটি ধারার প্রবাহ শুকিয়ে যাবে।

সত্যিই কি তাই? সুন্দরবনের গ্রামের ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে জনা তিরিশ দর্শকের মধ্যে বসে নিকৃষ্ট একটি দলের যাত্রা দেখতে দেখতে আমার কিন্তু অন্য রকম উপলব্ধি হল।

ওই যাত্রার দলটির মোট সদস্য কত জন? অভিনেতা-অভিনেত্রী, বাজনদার, লাইটম্যান, সাউন্ডম্যান, সব মিলিয়ে অন্তত জনা কুড়ি। পুরো দলটি এই যাত্রার জন্যে কত টাকা পেল জানেন? দুই হাজার টাকা। ভাববেন না আমাদের ট্যুর অপারেটর ওদের ঠকিয়েছে, মোটামুটি ওটাই বাঁধা দর। তার সাথে ওই প্যালার টাকা, সেও আর কত, সব মিলিয়ে হাজার খানেকের বেশী হবে না। এর মধ্যেই আলোর কারিকুরি, মাইক, সাজপোশাক, ভ্যানের ভাড়া, বাজনদারদের যন্ত্রপাতির ভাড়া, সব কিছু। তাহলে শেষ অবধি অভিনেতা অভিনেত্রীদের হাতে দেওয়ার জন্যে অধিকারী মশায়ের কাছে কি রইলো? শুধু পেন্সিল, আর কিচ্ছু না!

টাকার জন্যে যে নয় তা তো বোঝাই গেল, তাহলে কিসের জন্যে এই মানুষগুলো এই শীতের রাতে কোন দূর গ্রাম থেকে এসে আমাদের যাত্রা দেখিয়ে গেল? 

নেশা!!! 

এই একটি শব্দেই পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দেওয়া যায়। আগেকার দিনের বিখ্যাত নট-নটিদের লেখায় বা তাঁদের সম্বন্ধে লেখায় বিভিন্ন সময়ে পড়েছি, মঞ্চের আলোর মাঝে সামনের অন্ধকারের কালো কালো মাথাগুলোর সামনে সংলাপ বলার, গান করার, হাততালি পাওয়ার মধ্যে যে রোমাঞ্চ, তা অন্য কিছুতে পাওয়া যায় না। সেই রোমাঞ্চের সন্ধান অতীতে যেমন শিল্পীদের আগ্রহী করেছে, এই গ্রাম্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও তার ব্যতিক্রম নয়, সেই রোমাঞ্চের লোভে এরা যাত্রা করেই যাবে। আর্থিক লাভের লোভ মানুষ মাত্রেরই থাকে, প্রচারের ইচ্ছা মানুষ মাত্রেরই থাকে, এদেরও নিশ্চয় আছে। কিন্তু এরা জানে দুটোর কোনটাই ওদের কপালে জুটবে না, তবু দিনের পর দিন ওরা এমনি করে আমাদের যাত্রা শুনিয়ে যাবে। আমরা যারা দর্শক তারা দেখতে ইচ্ছুক বা অনিচ্ছুক সে নিয়ে ওদের মাথাব্যথা নেই, নিজেদের নেশার স্বার্থেই ওরা এই লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখবে। হয়তো অতীতের যাত্রার ধরণ বদলে গেছে, আরো যাবে, কিন্তু যাত্রাশিল্প রয়েই যাবে এদের হাত ধরে। হয়তো বড় ফণী, ছোট ফণী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধায়, কমল মিত্র, জহর গাঙ্গুলী বা এমন সর্বজনপ্রিয় আর কোন শিল্পী যাত্রার আসর থেকে উঠে আসবেন না, তবু যাত্রাশিল্প বেঁচে থাকবে, এই গ্রামের গরীব মানুষগুলোর মধ্যে দিয়েই, একেবারে মরবে না কোনদিন।

শিল্পীর মৃত্যু নেই, অভাবের চাপ, পরিস্থিতির চাপ শিল্পীকে কখনো দমাতে পারে না, এদেরকেও পারবে না.. 
ছবির সৌজন্য - লেখক